সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) মাত্র তিন দিনে পাকস্থলীর ক্যানসার থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪০ বছর বয়সী এক নারী। নারী ওই রোগী পাকস্থলীর অগ্রসর পর্যায়ের ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। অর্থাৎ ক্যানসারটি শুধু পাকস্থলীতে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং আশপাশের টিস্যু বা পেটের আস্তরণসহ অন্য অংশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। আর উন্নত চিকিৎসায় সেখান থেকেই মাত্র তিনদিনে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। আবুধাবির বুরজিল মেডিকেল সিটির চিকিৎসকেরা রোবট-সহায়ক সার্জারি ও এইচআইপিইসি কেমোথেরাপির সমন্বয়ে বিরল এই সফলতা অর্জন করেন।
সংবাদমাধ্যম খালিজ টাইমস বলছে, আয়শা নামে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৪০ বছর বয়সী এক নারী দীর্ঘদিন ধরে তীব্র পেটব্যথায় ভুগছিলেন। পরীক্ষার ফল হাতে পেতেই তিনি জানতে পারেন- এটি সাধারণ কোনও ব্যথা নয়, তার পেটে ক্যানসার ধরা পড়েছে। চিকিৎসকেরা জানান, এটি অগ্রসর পর্যায়ের পাকস্থলীর ক্যানসার, যার প্রাথমিক লক্ষণ পেটের আস্তরণেও ছড়িয়ে পড়ছিল। অতীতে পরিবারের কারও এই ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড না থাকায় এই খবরটি তার জন্য ছিল বিরাট এক ধাক্কা। কিন্তু চিকিৎসা শুরু হতেই তার পুরো পরিস্থিতি বদলে যায়।
আবুধাবির বুরজিল মেডিকেল সিটির (বিএমসি) চিকিৎসকেরা তার অবস্থা দেখে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসা শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। জেনারেল সার্জারি ও অনকোলজি বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মদ আদিলের তত্ত্বাবধানে তারা অত্যাধুনিক ও সমন্বিত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি বেছে নেন।
যদিও ক্যানসার তখনও ব্যাপকভাবে ছড়ায়নি, তবে পেটের আস্তরণে প্রাথমিকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় দ্রুত ও জটিল সার্জারি প্রয়োজন ছিল। এজন্য একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল গঠন করা হয়। এরপর সাইটোরিডাকটিভ সার্জারির মাধ্যমে ছয় ঘণ্টার দীর্ঘ অপারেশনে প্রথমে রোগীর শরীর থেকে দৃশ্যমান সব ক্যানসার অপসারণ করা হয়। এরপর দ্য ভিঞ্চি রোবট-সহায়ক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাকস্থলীর ক্ষতিগ্রস্ত অংশও অপসারণ করা হয়।
টিউমার অপসারণের পর চিকিৎসকেরা হাইপারথারমিক ইন্ট্রাপেরিটোনিয়াল কেমোথেরাপি (এইচআইপিইসি) প্রয়োগ করেন। এটি এক ধরনের উষ্ণ কেমোথেরাপি যা সরাসরি পেটের ভেতর প্রয়োগ করা হয় এবং এতে চোখে দেখা যায় না এমন ক্ষুদ্র ক্যানসার কোষও ধ্বংস হয়।
ডা. আদিল জানান, রোবট-সহায়ক প্রযুক্তি তাদের আরও নিখুঁতভাবে কাজ করতে সাহায্য করেছে এবং শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত অংশও কমিয়েছে। অন্যদিকে এইচআইপিইসি এমন অংশে কাজ করেছে, যেখানে সার্জনের চোখ পৌঁছায় না। দুটি পদ্ধতির সমন্বয়ে রোগীর ব্যথা কমেছে, রোগীর সেরে ওঠা দ্রুততর হয়েছে এবং ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও কমেছে।
আর চিকিৎসার এই জটিল প্রক্রিয়ার পুরোটা সময় জেনারেল সার্জারি ও অনকোলজি বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মদ আদিলকে সহায়তা করেন বুরজিল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের সিইও প্রফেসর হুমাইদ আল শামসি, ডা. আমিন এম. আবিয়াদ, ডা. জোয়াকিন পিকাজো ইয়েস্তে, ডা. নরমিন সাঈদ হাসানিনসহ নার্সিং টিম। তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় অবিশ্বাস্য ফল পাওয়া যায় এবং মাত্র তিন দিন পরই ওই রোগীকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়, যা সাধারণত এতো বড় ক্যানসার সার্জারির ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিরল।
চিকিৎসকেরা জানান, এই ঘটনাটি আমিরাতে ক্যানসার চিকিৎসায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বিশেষ করে এইচআইপিইসি পদ্ধতি সাধারণত পেরিটোনিয়ামে ছড়িয়ে পড়া ক্যানসারে ব্যবহার করা হয়— যেমন কোলোরেকটাল, ওভারি বা কিছু সারকোমা। আয়শার ক্ষেত্রে এটি ভবিষ্যতে ক্যানসার আবারও ফিরে আসার আশঙ্কাও কমিয়ে দিয়েছে।
এদিকে শারীরিকভাবে কঠিন এই চিকিৎসা চলাকালে আয়শা চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিকভাবে সহায়তা পেয়েছেন বলেও জানান। তিনি বলেন, ‘আমি ভাবতেই পারিনি এত দ্রুত আর কম কষ্টে সুস্থ হয়ে উঠব। মনে হচ্ছে জীবন নতুন করে শুরু হলো’। একই পরিস্থিতিতে থাকা মানুষদের প্রতি তার অনুরোধ, ‘আশা হারাবেন না। সময়মতো রোগ ধরা পড়লে আর আল্লাহর ওপর ভরসা থাকলে সবই সম্ভব।’
এফএস