রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলবে, সাইলেন্সার দিয়ে কালো ধোঁয়াও উড়বে, কিন্ত সেই ধোঁয়া পরিবেশের ক্ষতি করার আগেই বাতাসের বুক থেকে ভ্যানিশ হয়ে যাবে। এমনই এক বাস্তব ও যুগান্তকারী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন তরুণ বিজ্ঞানী শরীফ বরকতউল্লাহ। তিনি যশোর টিটিসির সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর ও শহরের পোস্ট অফিস পাড়ার নীলরতনধর বাইলেনের বাসিন্দা নেওয়াজ শরীফের ছেলে।
চলমান আঞ্চলিক স্কিলস এন্ড ইনোভেশন কম্পিটিশন খুলনাতে শ’ শ’ প্রজেক্টের ভিড়ে দর্শনার্থী ও বিচারকদের জটলা শরীফের স্টলে। সেখানে তিনি প্রদর্শন করছেন দীর্ঘ গবেষণার ফসল ‘বাতাস পরিষ্কারক কনক্রিট ব্লক’। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ ইটের ব্লক মনে হলেও, এটি মূলত পরিবেশ রক্ষার এক নীরব ও শক্তিশালী হাতিয়ার।
শহরে সমস্যার দেশীয় সমাধান ইট-পাথরের দালান আর পিচঢালা রাস্তাগুলো সাধারণত শ্বাস নেওয়ার বাতাসকে ভারি করে তোলে। কিন্তু শরীফের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এই মৃত দেওয়ালগুলো কাজ করবে একেকটি জীবন্ত গাছের মতো।
নিজের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে শরীফ বলেন, প্রায় পত্রিকা খুললেই বায়ুদূষণে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানের খবর দেখে খুব হতাশ হতাম। ভাবতাম, এর কি কোনো স্থায়ী সমাধান নেই? আমরা জানি গাছ লাগানো জরুরি, কিন্তু ঢাকা বা যশোরের মতো ঠাসাঠাসি শহরে তো নতুন করে বন তৈরি করার মতো জায়গার অভাব। তাই আমি ভাবলাম, আমাদের চারপাশের রাস্তা বা বিল্ডিংকেই কি কৃত্রিম গাছে রূপান্তর করা সম্ভব নয়?’ সেই ভাবনা, দীর্ঘ গবেষণা আর ল্যাবরেটরিতে দিনের পর দিন প্রচেষ্টার ফসলই আজকের এই ‘ন্যানো-কোটিং।
কীভাবে কাজ করে এই প্রযুক্তি প্রশ্নে শরীফ জানান, তার এই প্রজেক্টটি মূলত টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড (ঞরঙ₂) নির্ভর একটি ফটোক্যাটালাইটিক প্রযুক্তি। এটি সাধারণ দেওয়াল, রাস্তা, ফুটপাত বা ফ্লাইওভারের গায়ে স্প্রে করে দিলেই কাজ শুরু করে। প্রক্রিয়াটি বেশ অভিনব এবং সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়। দিনের বেলা যখন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি এই বিশেষ কোটিংয়ের ওপর পড়ে, তখন এর রাসায়নিক গঠন সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাতাসের বিষাক্ত গ্যাস যা মূলত গাড়ির ধোঁয়া থেকে নির্গত হয় এবং মানুষের শ্বাসকষ্টের প্রধান কারণ এই দেওয়ালের সংস্পর্শে আসে, তখনই এক বিশেষ জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া ঘটে। এই বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিষাক্ত গ্যাসটি ভেঙে নিরীহ নাইট্রেট লবণে পরিণত হয়। অর্থাৎ সূর্যের আলোই এখানে ফিল্টার হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে বৃষ্টির পানিতে এই লবণ ধুয়ে যায়, যা ড্রেনেজ সিস্টেমে গিয়ে মাটির উর্বরতা বাড়াতেও সাহায্য করে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো বিদ্যুৎ বা বাহ্যিক শক্তির প্রয়োজন হয় না।
শরীফ আরও জানান, এই প্রযুক্তির আরেকটি বড় সুবিধা হলো এর ‘সেলফ-ক্লিনিং’ বা স্বয়ংক্রিয় পরিষ্কার হওয়ার ক্ষমতা। সুপার-হাইড্রোফিলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এই কোটিং করা ভবনের গায়ে শ্যাওলা, ফাঙ্গাস বা ধুলোবালি জমতে পারে না। বৃষ্টির পানি পড়ার সাথে সাথেই দেওয়ালটি নতুনের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ নেই বললেই চলে। একবার ব্যবহার করলে প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত এটি কার্যকর থাকে, যা অর্থনৈতিকভাবেও অত্যন্ত সাশ্রয়ী। স্বপ্ন এবার স্মার্ট বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে শরীফের চোখে মুখে দৃপ্ত প্রত্যয়। তিনি বলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখি স্মার্ট ও সবুজ বাংলাদেশের। আমার আবেদন, দেশের হাইওয়ে, মেট্রো রেলের পিলার এবং ফ্লাইওভারগুলোতে যেন পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এতে করে আগামীর বাংলাদেশ হবে আরও সবুজ, নিরাপদ এবং বাসযোগ্য।’
বিজ্ঞান মেলায় আগত বিচারক এবং দর্শনার্থীরা এই প্রজেক্টের ভূয়সী প্রশংসা করছেন। অনেকেই মনে করছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে যশোরের এই তরুণের উদ্ভাবন দেশের পরিবেশ রক্ষায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
এফএস