গ্রামটির সড়কগুলোতে যেন স্তব্ধ নীরবতা বিরাজ করছে। একটু সামনে এগুতেই দৃষ্টি পড়ে—অনেক নারী-পুরুষ ও শিশু একটি বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছেন। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই কানে ভেসে আসে হৃদয়বিদারক কান্নার আহাজারি। সামনে তাকাতেই দেখা যায় সন্তানহারা বৃদ্ধ বাবার বুকফাটা আর্তনাদ। ঘরের ভেতরে নিহতের সন্তান, স্ত্রী ও স্বজনদের কান্নার সুরে আকাশ-বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠেছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে পাগলপ্রায় ফাতেমা বেগম। কৃষক সাইফুল সর্দারের মৃত্যু কেউই মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের আহাজারিতে গ্রামজুড়ে বইছে শোকের মাতম।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সরেজমিনে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণ জাটিগ্রাম এলাকায় গিয়ে এমনই করুণ দৃশ্য চোখে পড়ে।
গ্রাম্য আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাতের আঁধারে প্রতিপক্ষের অতর্কিত হামলায় খুন হন সাইফুল সর্দার। এ ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
নিহত কৃষক সাইফুল সর্দার উপজেলার সদর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণ জাটিগ্রাম এলাকার হবি সর্দারের ছেলে। তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলের বাবা। বৃদ্ধ বাবা ও স্ত্রীকে নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার ছিল তাঁর।
বাড়ির বারান্দায় বসে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন বৃদ্ধ বাবা হবি সর্দার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন,‘আমার দুই ছেলে ছিল। দুই বছর আগে বড় ছেলেটা মারা গেল। পাঁচ মাস আগে ওদের মা-ও চলে গেল। এখন আমার ছোট ছেলেকেও খুনিরা কুপিয়ে মেরে ফেলল। একজন পিতার জন্য সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়া যে কত বড় কষ্টের, তা বোঝানোর ভাষা আমার নেই। আমি বৃদ্ধ মানুষ, আমার তো যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু মরার আগে আল্লাহ যেন আমার চোখের সামনে ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখতে দেন।’
নিহত সাইফুল সর্দারের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন,‘আমরা রাতে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ পুলিশ পরিচয়ে প্রতিপক্ষের লোকজন ঘরে ঢুকে আমার স্বামীকে আমার চোখের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আমার স্বামী। আমার সব শেষ হয়ে গেল। সন্তানদের নিয়ে এখন কীভাবে সংসার চালাব, কার কাছে দাঁড়াব?’
এ সময় কথা হয় নিহত সাইফুল সর্দারের ১৩ বছর বয়সী মেয়ে ইলমা খানমের সঙ্গে। অশ্রুভেজা চোখে সে বলে,
‘আমার চোখের সামনে খুনিরা আমার বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমি তাদের পায়ে ধরে বলেছি, আমার বাবাকে আর মারবেন না, ছেড়ে দিন। কিন্তু তারা শোনেনি। পাষাণগুলোর মন একটুও গলেনি। আমাদের চোখের সামনেই বাবাকে শেষ করে দিল। আমরা এখন এতিম হয়ে গেলাম। যারা আমার বাবাকে কুপিয়ে মারছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই।’
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) ভোররাত ৩টার দিকে উপজেলার সদর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণ জাটিগ্রামে নিজ বাড়িতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সাইফুল সর্দার। গ্রাম্য বিরোধের জের ধরে ‘শুটার জুয়েল’ নামে পরিচিত জুয়েল মিয়ার নেতৃত্বে সবুজ মিয়া, হাসিব মিয়া, সৈয়দ রাজিব আলী, আইয়ুব মিয়া, নুরু মিয়া, শুভ মিয়া, শাহা সুলতান প্রিন্সসহ একদল সশস্ত্র লোক গভীর রাতে এলাকায় তাণ্ডব চালায়। তারা নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে প্রথমে সাইফুল সর্দারের ঘরে প্রবেশ করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। পরে পার্শ্ববর্তী ইসমাইল মোল্যার বাড়িতে গিয়ে তাকেও কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। হামলার পর আসামিরা অন্তত ৭–৮টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে পালিয়ে যায়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সাইফুল সর্দারকে গোপালগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। বর্তমানে গুরুতর আহত ইসমাইল মোল্যা ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁর অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
ময়নাতদন্ত শেষে শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকেলে সাইফুল সর্দারের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। ওই দিনই বিকেল ৫টায় ব্রাহ্মণ জাটিগ্রাম ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে সামাজিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
এদিকে সমবেদনা জানাতে নিহত সাইফুল সর্দারের বাড়িতে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের শতশত নারী-পুরুষ ছুটে আসছেন। তবে এই শোক সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা কারও জানা নেই।
স্থানীয়রা জানান, পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে অভাব-অনটনের মধ্যেও কখনও কারও কাছে হাত পাতেনি। এমন পরিবারের এই বিপর্যয় দেখে এলাকাবাসীও হতাশ।
সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সৈয়দ শরিফুল ইসলাম বলেন,‘দীর্ঘদিন ধরে গ্রামে দলাদলি চলছে। কিন্তু তার জন্য একজন ঘুমন্ত মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করতে হবে কেন? এখন তাঁর পরিবারের কী হবে? হত্যাকাণ্ডে জড়িত সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।’
আলফাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসনাত খান বলেন,‘হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ১০–১৫ জনের বিরুদ্ধে আলফাডাঙ্গা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ইতোমধ্যে এজাহারভুক্ত দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
এনআই