এইমাত্র
  • মেসিকে দেখতে না পেয়ে স্টেডিয়ামে সমর্থকদের ভাঙচুর
  • জামায়াতে যোগ দিলেন বিএনপি’র সাবেক এমপি
  • ওসমান হাদির পরিবারের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ
  • যারা নির্বাচন চায় না, তারাই হাদির ওপর হামলা করেছে: সালাউদ্দিন আহমেদ
  • ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করিয়ে আমরা ঘরে ফিরবো’
  • রাজধানীতে ১২ তলা ভবনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ১৪ ইউনিট
  • হাদিকে দেখতে হাসপাতালে তিন উপদেষ্টা
  • হাদিকে গুলি করা সন্ত্রাসীরা শনাক্ত, যেকোনো সময় গ্রেপ্তার: ডিএমপি কমিশনার
  • হাদির ওপর হামলা: রাতেই সারা দেশে ‘অলআউট’ অভিযান
  • এই হামলা বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত : প্রধান উপদেষ্টা
  • আজ শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ | ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫
    দেশজুড়ে

    রাখাইন জমিদারের পরিত্যক্ত জমি হাতাতে বেপরোয়া জালিয়াত চক্র

    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ৪ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৫৫ পিএম
    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ৪ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৫৫ পিএম

    রাখাইন জমিদারের পরিত্যক্ত জমি হাতাতে বেপরোয়া জালিয়াত চক্র

    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ৪ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৫৫ পিএম

    পর্যটনবান্ধব আধুনিক ও পরিকল্পিত কক্সবাজার গড়তে মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে সরকার। এর অংশ হিসেবে লক্ষ uকোটি টাকার বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে সমুদ্র শহরে। এ কারণে বেড়েছে ভূমির মান এবং দাম। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরিত্যক্ত (মালিকদের ততপরতাহীন জমি) জমি হাতিয়ে কোটিপতি বনতে ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করতে মাঠে সক্রিয় রয়েছে জালিয়াত চক্র। এদের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অগণিত অংশীদার। জমি হারিয়ে পথে বসেছেন অনেকেই।

    টেকনাফের এক রাখাইন জমিদারের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি হাতাতে সম্প্রতি নিজেকে ওয়ারিশ পরিচয় দিয়ে কক্সবাজার শহরের ক্যাং পাড়ায় বাস করা মং চিন সে নামে একজনের বেশকিছু কাগজপত্র সামনে আসার পর আদালত পাড়ায় হৈচৈ শুরু হয়েছে। মং চিন চক্র কক্সবাজার পৌরসভার প্যাড, কাউন্সিলর ও মেয়রের স্বাক্ষর স্কেনিং করে বসিয়ে জাল ওয়ারিশ ও মৃত্যু সনদ তৈরি করে স্বাধীনতার পরে মিয়ানমার চলে যাওয়া টেকনাফের এক রাখাইন জমিদারের একমাত্র ওয়ারিশ বলে পরিচয় দিচ্ছেন। অথচ জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) মতে তার জন্মস্থান পার্বত্য বান্দরবান। তিনি বান্দরবান পৌরসভার মধ্যমপাড়া পুরবী সুপার মার্কেট এলাকার থোয়াই চ অংয়ের ছেলে। কক্সবাজার পৌরসভার রাখাইন পাড়ায় এক নারীকে বিয়ে করে এখানে বাস করছেন। তার উপস্থাপন করা নথিগুলো সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের কর্মকান্ডের নমুনা বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।

    প্রতিবেদকের হাতে আসা কাগজপত্র পর্যালোচনা করে মিলেছে পিলে চমকানো লোমহর্ষক তথ্য। টেকনাফের সাবরাং মৌজার প্রায় ১৫ একর জমির মালিক বনে যেতে নিখুঁত ছক কষে মাঠে নেমেছে মং চিন সে ও তার সিন্ডিকেট। ওই জমির মুল ওয়ারিশদের অবস্থান না থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে টেকনাফের পরিবর্তে কক্সবাজার পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজবিহারী দাশের ভুয়া প্যাড, সিল ও নমুনা সই ব্যবহার করে জাল ওয়ারিশ ও মৃত্যু সনদ তৈরির কাজও সেরে নিয়েছে প্রতারক চক্রটি।

    স্থানীয় সূত্র ও কাগজপত্র ঘেটে জানা গেছে, টেকনাফের সাবরাং এলাকায় চিউ নামের এক রাখাইন জমিদার ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে দুর্বৃত্তদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন তিনি। এরপর তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ আত্মীয়-স্বজনরা মিয়ানমারে চলে যান। এরপর তাদের রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি দখলে নেয় স্থানীয়রা।

    সম্প্রতি দেশের প্রথম বিশেষায়িত সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ও মেরিনড্রাইভ সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে এর আশেপাশের জমির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। শিল্পপতি থেকে ব্যবসায়ী যার যেমন সাধ্য অনেকেই ক্রয় করেছেন এখানকার জমি।

    সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের পাশে জমিদার চিউর রেখে যাওয়া জমির মধ্যে সাবরাং মৌজার ১১৮৩, ১২০৪, ১৪৯৭, ১৪৯৮, ১৫০৩, ১৫০৪ খতিয়ানের প্রায় ১৫ একর জমি রয়েছে। জমিগুলো মেরিনড্রাইভের সাথে লাগোয়া এবং সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক সংলগ্ন হওয়ায় এর বাজার মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। একারণে জালিয়াত চক্রের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে ওই জমিতে।

    খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদ জমিদার চিউর কন্যা সিমাখেং প্রকাশ সিমাখাম নামের এক ব্যক্তির তিন পুত্র দাবি করে একটি ওয়ারিশ সনদ দেন। সেখানে সিমাখামের ওয়ারিশ হিসেবে যাদের দেখানো হয়েছে তারা হলেন- উথোইং, মংছেসে ও থোইওয়েন। এই ওয়ারিশ সনদের উল্লেখ করা মংছেসের নামের সাথে কিছুটা মিল থাকায় বান্দরবান থেকে কক্সবাজারে এসে বিয়ে করে আশ্রয় নেয়া মং চিন সে জমিগুলোর ওয়ারিশদার দাবি করতে মরিয়া হয়ে উঠেন। অথচ তার মা-বাবা এমনকি ঠিকানার সাথেও কোন সামঞ্জস্য না থাকলেও তিনি জমি জালিয়াতির জন্য অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন। জালিয়াত চক্রের সাথে মিলে মং চিন সে জমিগুলোর মালিক জমিদার চিউর পরর্বতী প্রজন্মের সবাইকে নিঃসন্তান ও মৃত হিসেবে দাঁড় করান।

    ওই জমিদার চিউ বংশের একমাত্র শেষ প্রদীপ দাবি করে কক্সবাজার পৌরসভার পাঁচটি ওয়ারিশ ও পাঁচটি মৃত্যু জাল সনদ তৈরী করে জমিগুলোর মালিক দাবি করে সেগুলো বিক্রি করতে নানা তৎবির শুরু করেন।

    নাম প্রকাশ না করার শর্তে জায়গা-জমির ব্যবসা করা এক ব্যক্তি জানান, মং চিন সে নামে এক রাখাইন ব্যক্তি টেকনাফের সাবরাং মৌজায় বেশ কিছু জমি ওয়ারিশ সূত্রে পেয়েছেন দাবি করে আমাকে ক্রয় করতে প্রস্তাব দেন। পরে তার উপস্থাপন করা কাগজপত্র নিয়ে ভূমি অফিসে তল্লাশি করে দেখে বুঝতে পারি প্রকৃতপক্ষে ওই জমির মালিক অন্য কেউ। তিনি পুরোটাই বাটপার। জাল সনদ তৈরী করে জমির মালিক দাবি করছেন।

    অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিকল্পিত কক্সবাজারের চলমান ধারার অপব্যবহার করে বহু মানুষকে পথে বসানোর চেষ্টা চলছে। ভূমি অফিস, এলএ শাখা এবং কিছু জনপ্রতিনিধি মিলে সংঘবদ্ধ চক্র নানা কৌশলে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলছে। বিশেষ করে মালিক তৎপরতা না থাকা, প্রবাসী, বিধবা এবং অসহায় মানুষকে টার্গেট করে চক্রটি নানা জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে। ইতোমধ্যে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে অনেক মানুষের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। জেলার বিভিন্ন থানা এবং আদালতে এই ধরনের ভূমি বিরোধ কিংবা জালিয়ত চক্রের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলা হচ্ছে।

    টেকনাফ পৌরসভার তিনবারের কাউন্সিলর আবদুল্লাহ মনির সাবরাং এলাকার স্থানীয়দের বরাতে বলেন, নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হওয়া জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণার পর হঠাৎ জমির দাম বেড়েছে। দীর্ঘ অবহেলায় প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা ভূমি মালিকদের অধিকাংশ জমিরই কাগজপত্র আপডেট ছিল না। যেখানে মূল মালিক নেই এসব ভূমির ব্যাপারে সৃষ্টি হচ্ছে নানা চক্র। আবার কোথাও কোথাও জমি রাতারাতি দখল-বেদখলের ঘটনা ঘটছে। ভূমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এই ধরনের দখল-বেদখল এবং জালিয়ত চক্র ক্রমে বাড়ছে। বিশেষ করে মালিক বিহীন জমি, প্রবাসী ও বিধবাদের টার্গেট করে সংঘবদ্ধ চক্র মাঠে সক্রিয় রয়েছে।

    কক্সবাজার সিটি কলেজের ট্যুরিজম অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মঈনুল হাসান চৌধুরী পলাশ বলেন, টেকনাফের ওইসব জমিগুলোর রাস্তাঘাট ছিলোনা। জায়গাগুলো ছিল পতিত। রাস্তার কারণে ভূমিগুলো কোটি কোটি টাকার সম্পদ হয়ে উঠেছে। এক একর জমি এক-দুই লাখ টাকায় বিক্রি করতে কষ্ট হতো। সেখানে এখন কাঠা বিক্রি হচ্ছে ১৫/২০ লাখ টাকায়। মৌজা দরের তিন গুণ ক্ষতিপূরণ পাওয়া এসব প্রকল্প এলাকায় যাদের ভূমি রয়েছে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। তবে এই লাভ অনেকের জন্য গলার কাঁটা হয়েছে।

    কক্সবাজার পৌরসভার ৮ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজ বিহারী দাশ বলেন, ওয়ারিশ সনদ উপস্থাপন করা মং চিন সে বান্দরবানের বাসিন্দা। তিনি আমার ওয়ার্ডের এক নারীকে বিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। তাকে এই ধরনের ওয়ারিশ কিংবা মৃত্যু সনদ কখনো দেয়া হয়নি। কম্পিউটার থেকে আমাদের প্যাড, সিল ও স্বাক্ষর প্রিন্ট করে এইসব সনদ তৈরী করেছেন। তার তৈরী করা কাগজপত্রের স্বারক নং দেখলে যে কেউই বুঝতে পারবে এগুলো নকল।

    তিনি আরো বলেন, এছাড়া তিনি জাল সনদ তৈরী করতে গিয়ে ২০১৮ সালে আমাকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র দেখিয়েছেন। তখন আমি ভাপরপ্রাপ্ত মেয়রই ছিলাম না। মেয়র এবং পৌরসভার কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ করে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন বলে উল্লেখ করেন এ জনপ্রতিনিধি।

    কক্সবাজারের একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক জমিতে মালিকানার বিরোধ তৈরি হয়েছে। জায়গা-জমির গুরুত্ব এবং দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতারক চক্রের তৎপরতা বেড়েছে। তবে বর্তমানে ভূমি মালিকানার কাগজপত্র যেভাবে তৈরি হচ্ছে তাতে এই ধরনের অনাহূত বিরোধ কমে যাবে। অনলাইন সুবিধা জালিয়াতি করার দিন শেষ করে দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    সর্বশেষ প্রকাশিত

    Loading…