একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈধতা নির্ভর করে তার নাগরিকদের জীবন, জানমাল ও মৌলিক অধিকার কতটা সুরক্ষিত তার ওপর। রাষ্ট্র কেবল শাসন করার জন্য নয়; সংবিধানের আলোকে নাগরিকের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে, রাষ্ট্র কি তার সেই সাংবিধানিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে? বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা- ৭(১) অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং সংবিধানই সর্বোচ্চ আইন। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সব কার্যক্রমের বৈধতা ও সীমা নির্ধারিত হয় সংবিধান দ্বারা। সেই সংবিধানই আবার নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার ধারা-৩২ অনুযায়ী "আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।" জীবন মানে কেবল শারীরিক অস্তিত্ব নয়; বরং নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও ভীতিমুক্ত জীবনযাপন। কিন্তু বাস্তবতা হলো নাগরিক আজ নানাভাবে জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সহিংসতা, সামাজিক অস্থিরতা, সড়ক ও কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই পরিস্থিতি ধারা- ৩২ এর মৌলিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সংবিধানের ধারা- ২৭ নাগরিকদের আইনের দৃষ্টিতে সমান ঘোষণা করেছে এবং ধারা- ৩১ আইনের আশ্রয় ও ন্যায়সঙ্গত আচরণের নিশ্চয়তা দিয়েছে। কিন্তু যখন অপরাধের ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের দায়মুক্তি দেখা যায়, তদন্ত ও বিচার দীর্ঘসূত্রতায় আটকে থাকে এবং সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পেতে হিমশিম খায় তখন এই অনুচ্ছেদগুলো কার্যত দুর্বল হয়ে পড়ে। আইনের শাসন দুর্বল হলে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারহীনতা সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সংবিধানের ধারা- ৩৯(১) ও (২) নাগরিকের চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। এই অধিকার গণতন্ত্রের প্রাণ। ভিন্নমত, সমালোচনা ও নাগরিক প্রশ্ন ছাড়া রাষ্ট্র কখনো জবাবদিহিমূলক হতে পারে না। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ভীতি, আত্মসংযম ও অনিশ্চয়তা বাড়ছে। নাগরিক যখন ভয় পায় কথা বলতে, তখন গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় সীমাবদ্ধ থাকে, চর্চায় নয়। সংবিধানের ধারা- ৪৪ নাগরিককে মৌলিক অধিকার প্রয়োগ ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার দিয়েছে এবং ধারা- ১০২ হাইকোর্ট বিভাগকে এই অধিকার রক্ষায় রিট জারি করার ক্ষমতা দিয়েছে। এটি একটি শক্তিশালী সাংবিধানিক সুরক্ষা ব্যবস্থা। তবে প্রশ্ন থেকে যায় একটি কার্যকর রাষ্ট্রে কি নাগরিককে প্রতিনিয়ত আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে? মৌলিক অধিকার রক্ষা রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত, শেষ আশ্রয় নয়।
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ধারা- ১৮ (ক) রাষ্ট্রকে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে নির্দেশ দিয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় মানবিক নিরাপত্তা কেবল মানুষকেন্দ্রিক নয়; পরিবেশ ও প্রাণীর নিরাপত্তাও এর অংশ। পরিবেশ ধ্বংস ও প্রাণীর প্রতি সহিংসতা শেষ পর্যন্ত মানুষের জীবন ও জীবিকাকেই হুমকির মুখে ফেলে।
নাগরিক নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার রক্ষা রাষ্ট্রের কোনো সদিচ্ছার বিষয় নয়। এটি সংবিধানপ্রদত্ত বাধ্যবাধকতা। যখন নাগরিক জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, ন্যায়বিচার নিয়ে আস্থা হারায় এবং মতপ্রকাশে সংকোচ বোধ করে তখন তা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র টিকে থাকে নাগরিকের আস্থার ওপর। সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল, মানবিক ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবিক নিরাপত্তা এই তিন ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান অগ্রগতি এখন সময়ের দাবি। গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে প্রথমেই রক্ষা করতে হবে নাগরিকের জীবন ও মৌলিক অধিকার। সংবিধান সে পথ দেখিয়ে দিয়েছে; এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।
লেখকঃ জোসেফ মাহতাব, মানবাধিকার কর্মী।
এসআর