রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগে কর্মরত এক নারী কর্মীর সঙ্গে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে দীর্ঘদিন সম্পর্ক স্থাপন, পরে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি, শারীরিক নির্যাতন, ভয়ভীতি ও চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের চাপ দেওয়ার অভিযোগ ঘিরে তীব্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ভুক্তভোগীর অভিযোগে উঠে এসেছে, এই ঘটনার নেপথ্যে কেবল ব্যক্তি সম্পর্ক নয়, বরং দপ্তরের ক্ষমতা ব্যবহার করে একটি সংঘবদ্ধ হয়রানি ও চাপ প্রয়োগের চিত্র।
ঘটনাটি ইতোমধ্যে গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। অভিযুক্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। আদালতের নির্দেশে বিষয়টি বর্তমানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), চট্টগ্রাম কর্তৃক তদন্তাধীন রয়েছে।
ভুক্তভোগী সাজেদা আক্তার অভিযোগে জানান, তিনি ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের সিএসটিই/পূর্ব দপ্তরে অফিস সহায়ক (টিএলআর) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। একই দপ্তরের অফিস সহকারী আবদুল্লাহ আল মামুন ধীরে ধীরে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে বিয়ের আশ্বাস ও ভবিষ্যৎ সংসারের স্বপ্ন দেখিয়ে তাকে সম্পর্কের গভীরে নিয়ে যাওয়া হয়।
অভিযোগে বলা হয়, আবদুল্লাহ আল মামুন তার ছোট বোনের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সাজেদা আক্তারকে বিয়ে করবেন, এমন আশ্বাস দিয়ে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্কে জড়ান। এই আশ্বাসের ওপর ভর করেই সম্পর্কটি দীর্ঘদিন চলতে থাকে।
চাঞ্চল্যকর অভিযোগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ঘটনাটি দপ্তরের একাধিক ব্যক্তি জানতেন বলে দাবি করা হয়েছে। সাজেদা আক্তার তার লিখিত অভিযোগে সিএসটিই/পূর্ব দপ্তরের প্রধান সহকারী মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে এই সম্পর্কের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করেন।
ভুক্তভোগীর ভাষ্য অনুযায়ী, কয়েক মাস আগে আবদুল্লাহ আল মামুন হঠাৎ করেই বিয়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন। বিয়ে করতে চাপ দিলে তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে উদ্যোগ নেন।
অভিযোগে বলা হয়, ৪ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে সিআরবি এলাকায় অবস্থিত সিএসটিই অতিরিক্ত দপ্তরে ডেকে নেওয়া হয় সাজেদা আক্তারকে। সেখানে তাকে শারীরিকভাবে মারধর করা হয়। এতে তার মাথা ও হাতে গুরুতর আঘাত লাগে এবং রক্তক্ষরণ হয়।
ওই সময় ঘটনাস্থলে মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও মিসরাত সেহের উপস্থিত ছিলেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
মারধরের পর সাজেদা আক্তার হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন এবং চট্টগ্রাম কোতোয়ালী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। অভিযোগ অনুযায়ী, এরপর শুরু হয় নতুন অধ্যায়, ‘মীমাংসা’র নামে চাপ প্রয়োগ।
ভুক্তভোগীর দাবি, মো. মোস্তাফিজুর রহমান তাকে মামলা ও অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেন। চাকরি হারানোর ভয় দেখানো হয় এবং অর্থের বিনিময়ে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
সাজেদা আক্তার সমঝোতায় রাজি না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয় বলে অভিযোগ করেন। মৌখিক আদেশে প্রথমে তাকে ডিএসটিই/চট্টগ্রাম দপ্তরে এবং পরে চট্টগ্রাম জংশন কেবিনে খালাসী পদে যোগদান করতে বাধ্য করা হয়।
ভুক্তভোগীর ভাষ্য অনুযায়ী, এটি ছিল পরিকল্পিতভাবে তাকে হেয় করা ও পেশাগতভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা।
এই প্রসঙ্গে সাজেদা আক্তার সময়ের কন্ঠস্বরকে বলেন, “একজন নারী হিসেবে আমি চরম মানসিক যন্ত্রণা ও সামাজিক অপমানের মধ্যে আছি। আমি আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। মামলা তুলে নিতে আমাকে নিয়মিত চাপ দেওয়া হচ্ছে। চাকরি হারানোর ভয় দেখানো হচ্ছে। তবুও আমি ন্যায়বিচার চাই।”
ঘটনার পর তিনি আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-০৬, চট্টগ্রাম-এ মামলা দায়ের করেন। আদালতের নির্দেশে মামলাটি বর্তমানে পিবিআই, চট্টগ্রাম কর্তৃক তদন্তাধীন রয়েছে।
একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব), চট্টগ্রামের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত আবদুল্লাহ আল মামুনের মন্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এসআর