হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার নাম আমরা সবাই জানি। ফোরাত নদীর তীরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া তৎকালীন সময়ের উন্নত এক শহরের নাম বাবেল। যার অবস্থান প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার (ইরাক) মধ্যে। কথিত আছে নবী সোলায়মান (আ.)–এর সময়ে এই দুই ফেরেশতা এই বাবেল শহরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
এ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে সুরা বাকারার ১০২ নং আয়াতের ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে। পবিত্র কোরআনের ভাষ্যমতে, ‘তারা ওই শাস্ত্রের অনুসরণ করল, যা সোলাইমানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। সোলাইমান কুফরি করেননি; শয়তানরাই কুফরি করেছিল।
যখন মানুষেরা দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালার সাথে নাফরমানী ও কুফরীতে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহ তায়ালাকে বলেছিলেন: হে আল্লাহ! তুমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছ তোমার ইবাদাত ও আনুগত্য করার জন্য। কিন্তু, তারা কুফরী করছে, মানুষ হত্যা করছে, অন্যদের সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষন করছে, চুরি-ডাকাতি, ব্যভিচার, মদপান ইত্যাদি অপরাধে লিপ্ত রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বললেন: তারা আমার আযাব দেখেনি। তোমরা তাদের জায়গায় থাকলে তোমরাও একই কাজ করতে। তারা বললেন: না, এটা অসম্ভব। আমাদের দ্বারা এমন অপরাধ সংঘটিত হতেই পারে না। তখন আল্লাহ তায়ালা বললেন: ঠিক আছে, তোমাদের মধ্য থেকে দুইজন ফেরেশতাকে নির্ধারণ করে দাও। আমি তাদেরকে কিছু বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করব এবং কিছু বিষয়ে নিষেধ করব। তারা হারুত ও মারুত নামক দুইজন ফেরেশতাকে সিলেক্ট করলেন। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। তাদের উপর নির্দেশ ছিল আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত করার এবং নিষেধাজ্ঞা ছিল তার সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন, অন্যায়ভাবে মানুষ খুন, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষন, চুরি ডাকাতি, জ্বিনা-ব্যভিচার ও মদপান ইত্যাদির উপর।
অথপর তারা পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন এবং হারুত–মারুত তখন কিছু লোককে জাদু শিখিয়েছিলেন। শেখানোর শর্ত ছিল, সেই জাদু কারও ওপর প্রয়োগ করা যাবে না। জাদুবিদ্যা যে আসলে মন্দ, সবাইকে এটা শেখানোর জন্যই তাঁরা এসেছিলেন। নবীরা মুজিজা দেখান। মুজিজা জাদু নয়। তারা মানুষকে জাদুবিদ্যা এবং বাবেল শহরে হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। তবে তারা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ হিসেবে এটাও বলে দিতেন যে ‘আমরা পরীক্ষার জন্য, কাজেই তুমি কাফের হয়ো না।’ কিন্তু লোকজন সেসব শিক্ষা করে অসৎ কাজে ব্যবহার করতে শুরু করল।
অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যা দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তা দ্বারা কারো অনিষ্ট করতে পারত না। তারা তা-ই শিখে, যা তাদের ক্ষতি করে এবং কোনো উপকার করে না। তারা ভালোরূপে জানে, যে কেউ জাদুবিদ্যা চর্চা করে, তার জন্য পরকালে কোনো অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ—যদি তারা জানত!’ (সুরা বাকারা, আয়াত : (সুরা বাকারা, আয়াত : ১০২)
আলোচ্য আয়াতে হারুত ও মারুত বলে দুটি নাম রয়েছে। যাঁদের নিয়ে রচিত হয়েছে নানা কল্পকাহিনি। গদ্য-পদ্য আর সাহিত্যরসে ভরপুর সেসব ঘটনাবলি কমবেশি সবাই জানেন।
ইমাম তাবারি (রহ.) ও ইবন জারির (রহ.)-এর মতে, কোরআনের আয়াতে উল্লিখিত শব্দ ‘মালাকাইনে বা মালিকাইনে’ এখানে দুটি পঠন রীতিই চালু আছে। যদি বলা হয় ‘মালিকাইনে (দুজন শাসক)’, তাহলে এর ব্যাখ্যা হলো হারুত মারুত কোনো ফেরেশতা নন বরং তৎকালীন সময়ের দুজন বাদশা, যাঁরা কোনো অপরাধ করেছিলেন আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন যে আমাদের দুনিয়াতেই শাস্তি দিন। আল্লাহ সেটি কবুল করেছেন ও দুনিয়াবাসীর শিক্ষার জন্য নিদর্শন হিসেবে সেভাবে রেখেছেন। যেন মানুষ জাদু নামক কুফরি থেকে বিরত থাকে।
আর যদি ‘মালাকাইনে (দুজন ফেরেশতা)’ বলা হয়, তাহলে এর ব্যাখ্যা হলো মহান আল্লাহ তাআলা নিজ সৃষ্টি ফেরেশতাদ্বয়কে ইচ্ছা করেই এভাবে রেখেছেন যেন তাঁরা মানুষকে জাদুর বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারেন। এটি তাঁদের কোনো শাস্তির কারণে নয়। কারণ ফেরেশতারা কোনো অপরাধ করতে পারেন না। তাঁদের সে যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টিই করা হয়নি। যেমন কোরআনের সুরা তাহরিমের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ফেরেশতা অমান্য করে না তা, যা আল্লাহ তাঁদের আদেশ করেন। আর তাঁরা যা করতে আদেশপ্রাপ্ত হন তা-ই করেন। (সুরা তাহরিম, আয়াত : ৬)
ইমাম ইবনে কাসীর (রহঃ) তার রচিত তাফসীরে ইবনে কাসীরে সুরা বাকারার ১০২ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় উপরের কাহিনী উল্লেখ করে বলেছেন- এগুলো ইহুদীদের মনগড়া কাল্পনিক কিচ্ছা-কাহিনী। এ ছাড়াও তিনি তার অপরগ্রন্থ আল বিদায়াহ ওয়ান নেহায়াহতেও একই কথা বলেছেন। (আল বেদায়াহ ওয়ান নেহায়াহ: আসমান সৃষ্টি অধ্যায়)
আল্লামা আলুসী (রহঃ) তার রচিত "তাফসিরে রুহুল মাআনীতে" কাযি আয়াজ (রহঃ) এর সুত্রে উল্লেখ করেছেন: "বিভিন্ন তাফসীর কারকরা হারুত মারুতের কাহিনীতে যা কিছু উল্লেখ করেছেন তার কোন কিছুই রাসুল (সাঃ) থেকে সহীহ কিংবা দুর্বল কোন সুত্রেই বর্ণিত হয়নি।"
এছাড়াও ইমাম আশ-শিহাব আল-ইরাকী (রহঃ) বলেছেন: যে বিশ্বাস করবে যে, হারুত ও মারুত নামক দুইজন ফেরেশতাকে যোহরার সাথে অপরাধে লিপ্ত হওয়ার কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে সে যেন মুলতঃ মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে কুফরী করল। কেননা আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের সম্বন্ধে বলেছেন:
অর্থাৎ, তারা (ফেরেশতাগণ) আল্লাহ তায়ালার কোন নির্দেশ অগ্রাহ্য করে না। আর তাদেরকে যা কিছুর নির্দেশ দেয়া হয় তাই তারা পালন করে। (সুরা তাহরীম:৬)
এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: অর্থাৎ, তারা অহংকার করে তাঁর বন্দেগী থেকে বিমুখ হয় না আবার ক্লান্ত ও হয় না। দিন রাত তাঁর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করতে থাকে,বিশ্রাম নেয় না। (সুরা আম্বিয়া: ১৯-২০)
আর রাসুল (সাঃ) ও সাহাবীদের নামে তারা উক্ত তারাকে লানত করতেন বলে যে বর্ণনা এসেছে তা রাসুল (সাঃ) এর নামে মিথ্যা। রাসুলের নামে মিথ্যা হাদীস যারা তৈরী করে এটা তাদের কাজ। (তাফসীরে রুহুল মা'আনী: সুরা বাকারাঃ ১০২ নং আয়াত)