এইমাত্র
  • দেশের সব নির্বাচন অফিসে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
  • স্বামীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যার অভিযোগ, স্ত্রী ও প্রেমিক আটক
  • রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্দে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা চান এরদোয়ান
  • ওসমান হাদির ওপর হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করছে না বিএনপি
  • ছুটির দিনেও খোলা থাকবে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়
  • ওসমান হাদির ওপর হামলার পর পানছড়ি সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার
  • ১২ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি জাবালে নূর টাওয়ারের আগুন
  • চট্টগ্রাম-১৫ আসনে বিএনপি’র প্রার্থীকে জরিমানার পর শোকজ
  • আফগানিস্তানকে ৩ উইকেটে হারাল বাংলাদেশ
  • ডেঙ্গুতে একদিনে আক্রান্ত ৫৭২
  • আজ রবিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ | ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
    দেশজুড়ে

    সিরাজদিখানের পাতক্ষীর পেলো জিআই পণ্যের স্বীকৃতি

    আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৫৬ পিএম
    আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৫৬ পিএম

    সিরাজদিখানের পাতক্ষীর পেলো জিআই পণ্যের স্বীকৃতি

    আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৫৬ পিএম

    জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেটর (জিআই) ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার দুগ্ধ জাতীয় মিষ্টান্ন সুস্বাধু পাতক্ষীর। এ স্বীকৃতিতে উপজেলার সন্তোষপাড়া গ্রামের পাতক্ষীরের কারিগরা আনন্দে ফেটে পড়েছেন।

    পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের আয়োজনে বুধবার (৩০ এপ্রিল) বিশ্ব মেধা দিবস ও নিবন্ধনকৃত ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের সনদ প্রদান করা হয়।

    এদিন বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমির মাল্টিপারপাস হলে এ আয়োজন করে। সেখানে পাতক্ষীরপেয়েছে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি।

    ২০২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুজাফর রিপন আবেদন করে ছিলেন। দীঘদিন পর স্বীকৃতি পাওয়ার মধ্য দিয়ে মিলেছে এতিহ্যের স্মারক।

    বিখ্যাত দুগ্ধ খাবার পাতক্ষীরের ইতিহাস

    এদিকে, উপজেলার রশুনিয়া ইউনিয়নের সন্তোষপাড়া গ্রামের বেশ কিছু পরিবার বংশ পরম্পরায় এখনো পাতক্ষীর তৈরির কাজে জড়িত। লিপিবদ্ধ ইতিহাস তেমন ভাবে না থাকলেও মুঘল আমলে ঢাকাবাসীর খাদ্য তালিকায় পাতক্ষীরের নাম পাওয়া যায়।

    লোকমুখে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো এই পাতক্ষীরের উৎপত্তি বিক্রমপুর তথা সিরাজদিখান এই অঞ্চলের পুলিন বিহারী দেবের হাত ধরে। তিনিই সর্বপ্রথম তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে পাতক্ষীর তৈরি করে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করতে শুরু করে ছিলেন। তাদের থেকে দেখে শিখে একই সময়ে ইন্দ্রমোহন ঘোষ এবং লক্ষ্মী রানী ঘোষও তৈরি করতে শুরু করেন পাতক্ষীর। এখন তাদের বংশধররাই বানাচ্ছেন এই ক্ষীর। তাদের উত্তরসূরি কার্তিক চন্দ্র ঘোষ, ভারতী ঘোষ, সুনীল চন্দ্র ঘোষ, রমেশ ঘোষ, বিনয় ঘোষ, মধুসূদন ঘোষ, সমীর ঘোষ ও ধনা ঘোষ এই পেশায় রয়েছেন। কিন্তু এই পাতক্ষীর পারিবারিক ঐতিহ্য ও ব্যবসা হলেও জানা যায়, পরিবারের মেয়েদের এই মিষ্টি বানানোর রীতি শেখানোহয় না। এই পদ্ধতি রপ্ত করে তাদের পরিবারের পুত্রবধূরা।

    কারণ হিসেবে জানা যায়, মেয়েরা বিয়ের পর অন্যত্র চলে যায়, যাতে তাদের এই মিষ্টি বানানোর পদ্ধতি বিয়ের পর হস্তান্তর না হয়। তবে বর্তমানে দোকানের কারিগররাই পাতক্ষীর তৈরি করেন।

    বিখ্যাত দুগ্ধ খাবার পাতক্ষীর তৈরি

    সিরাজদিখান নামের সাথে জড়িত ও খাদ্য সংস্কৃতির সাথে মিশে যাওয়া এক মিষ্টান্ন খাবার পাতক্ষীর। শব্দটা পাতক্ষীর, তবে অনেকে পাতাক্ষীর বা পাতক্ষীরাও বলে থাকে। দুধের তৈরি এই মিষ্টি কলা পাতায় মোড়ানো থাকে, দেখতে হালকা হলুদাভ বর্ণের, চ্যাপ্টা এবং গোল আকৃতির। প্রতি পাতায় প্রায় ৫০০ গ্রাম পাতক্ষীর থাকে। প্রায় ৬ কেজি দুধ জ্বাল করে ১ কেজি পাতক্ষীর বানানো হয়। এই অঞ্চলে পাতক্ষীরের আলাদা বিশেষত্ব হচ্ছে এই খাবারটি পুরোপুরিই দুধে তৈরি। অন্যান্য উপকরণ যেমন হলুদ ও চিনির পরিমাণটা খুবই নগণ্য। এই এলাকায় প্রচুর গাভী পালন করা হয়, তাই প্রচুর পরিমানে দুধ পাওয়া যায়।

    কাঁচামাল হিসেবে সিরাজদিখান বাজার থেকেই তারা দুধ ক্রয় করে থাকেন। পাতক্ষীরের কাঁচামাল দুধ এবং পাতক্ষীর এই এলাকা থেকেই সংগৃহীত হয়। প্রতিদিন পাতক্ষীর এবং অন্যান্য মিষ্টির জন্য সিরাজদিখান বাজারে প্রায় ২০০ মণ দুধ বিক্রি হয়। সময় ভেদে পাতক্ষীরের চাহিদা এবং বিক্রি হ্রাস বৃদ্ধি হয়। দুধের তৈরি খাবার হওয়ায় গরমের তুলনায় শীতে বেশি বিক্রি হয়। কারণ পাতক্ষীর দিয়ে তখন পাটিশাপটা, মুখশোলা, ক্ষীরপুলির মত নানা রকম পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। এই অঞ্চলের নানা উৎসব-আয়োজনে বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পাতক্ষীরের পরিবেশনা থাকবেই। এটি না হলে যেন আয়োজন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই এই এলাকার মেহমানদারি বা বড় বড় আয়োজনে পাতক্ষীর অবশ্যই থাকা চাই। বাঙালি ঐতিহ্যের পাটিসাপটা পিঠা তৈরিতেও প্রয়োজন হয় পাতক্ষীরের। এমনকি এই এলাকায় নতুন জামাইয়ের সামনে পিঠাপুলির সঙ্গে পাতক্ষীর ব্যবহার না করার কথা চিন্তাও করা যায় না। এই অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে চিড়া-মুড়ির সঙ্গেও পাতক্ষীর খাওয়ার পুরোনো রীতি প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই মেহমান আপ্যায়নে সেমাই, পায়েসের সঙ্গে পাতক্ষীর পরিবেশন করে থাকেন।

    কোথায় গেলে পাবেন এই পাতক্ষীর

    সিরাজদিখান বাজারে এই পাতক্ষীর তৈরি এবং বিক্রি হয়। এতে জেলার অন্য কোন উপজেলা কিংবা বাংলাদেশের আর কোন জেলায় এই পাতক্ষীর পাওয়া যায় না। পাইকারী ভাবে কোন ব্যবসায়ীর নিকট এই পাতক্ষীর বিক্রি করা হয় না। তবে অল্প কিছু ই-কমার্স উদ্যোক্তারা এখান থেকে পাতক্ষীর নিয়ে অনলাইনে বিক্রি করেন।

    সিরাজদিখান বাজারে পাতক্ষীরের ১৭ টি দোকান রয়েছে। রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার,মা ক্ষীর ভান্ডার, জগন্নাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, সমীর ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মহাগুরু মিষ্টান্ন ভান্ডার নামে দোকানগুলো উল্লেখযোগ্য। সব দোকানেই গরম কালের তুলনামূলক কম পাতক্ষীর বিক্রি হয়, দৈনিক গড়ে ৪০-৫০ পাতা। শীতকালে বেশি বিক্রি হয়, প্রতি দোকানে দৈনিক গড়ে ২০০-২৫০ পাতা। গরম কালে দৈনিক গড়ে প্রায় ৩-৪ হাজার টাকার পাতক্ষীর বিক্রি হয় এবং শীতকালে ১৫-২০ হাজার টাকার মত বিক্রি হয়। সাধারণত ৬ লিটার দুধ থেকে তৈরি এক কেজি সুস্বাদু পাতক্ষীর ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকায় পাওয়া যায়।

    পাতক্ষীর তৈরির কারিগররা জানান, প্রথমে সামান্য আঁচে দুধ গরম করে ঢালা হয় বড় কড়াইয়ের মতো দেখতে তাফালে। এরপর এক ঘণ্টা সেই দুধ জ্বাল দিয়ে কিছুটা ঘন করে মেশানো হয় হলুদগুঁড়া। আবারও আধা ঘণ্টা ধরে জ্বাল দেওয়ার পর যোগ করা হয় চিনি।

    রশুনিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জয়ন্ত ঘোষ বলেন, সন্তোষপাড়া গ্রামে একমাত্র তাঁদের পরিবার এই ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি ও বাজারজাত করে আসছে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা রাত জেগে মাটির চুলায় মণে মণে দুধ জ্বাল দিয়ে এটি তৈরি করতেন। সিরাজদিখান বাজারে তাঁদের প্রতিষ্ঠান রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারে বিক্রি হয় পাতক্ষীর, বিশেষ করে শীত মৌসুমে প্রবাসীদের কাছ থেকে অনেক ক্রয়াদেশ আসে তাঁদের কাছে।

    জয়ন্ত ঘোষ জানান, ইউরোপ-আমেরিকার বাঙালি কমিউনিটির অনেক বিখ্যাত মিষ্টিপণ্যের দোকান বাসুপারশপেও বিক্রি করা হয় পাতক্ষীর। তা ছাড়া শীতকালে নতুন জামাইকে পিঠা-পুলির সঙ্গে এ ক্ষীর খেতে দেওয়া এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের চল।

    সিরাজদিখান বাজারের রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারে বর্তমানে তিন ভাই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তাঁরা হলেন শরৎ ঘোষ, মাধব ঘোষ ও খোকন ঘোষ। খোকন ঘোষ বলেন, তাঁর ভাই প্রয়াত সুনীল ঘোষ মিষ্টির দোকানটি চালু করেছিলেন। তিনি ছিলেন পাতক্ষীর তৈরির প্রধান কারিগর। ভাইয়ের কাছ থেকে তাঁদের ক্ষীর বানানোর হাতেখড়ি। বংশপরম্পরায় পাতক্ষীর তৈরির প্রক্রিয়া ও প্রচলন চলে গেছে সেই পরিবারের তিন ভাই ও তাঁদের সন্তানদের কাছে। বর্তমানে ঘোষ পরিবার ছাড়াও উপজেলার আরও কয়েকটি পরিবার পাতক্ষীর তৈরি ও বিক্রি করেন। বর্তমানে ৭০০ থেকে ১হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

    মহাগুরু মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী সুশান্ত ঘোষ বলেন, পাতক্ষীরের সব উপকরণ এই অঞ্চল থেকেই সংগ্রহ করা হয়। পাতক্ষীর বানাতেও প্রচুর পরিমাণ দুধ পাতিলে ঢেলে দীর্ঘসময় ধরে জ্বাল দিতে দিতে কাঠের চামচ দিয়ে নাড়তে হয়, যাতে পাতিলের তলায় দুধ লেগে না যায়। এরপর দুধ ঘন হয়ে এলে সামান্য হলুদ ও পরিমিত পরিমাণ চিনি মিশিয়ে চুলা থেকে নামানো হয়। পরিমানের অনুপাত যদি ধরা হয় তাহলে ৩০ লিটার দুধে ৭৫০ গ্রাম চিনি ও দুই চা চামচ হলুদ বাটা মিশিয়ে প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা জ্বাল দেওয়া ও নাড়াচাড়া করতে করতে পাঁচ কেজি ক্ষীর তৈরির মাধ্যমে প্রস্তুত হয় এই সুস্বাদু মিষ্টান্ন।

    উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিনা আক্তার বলেন, উপজেলার সন্তোষপাড়া গ্রামের বেশ কিছু পরিবার বংশ পরম্পরায় এখনো পাতক্ষীর তৈরির কাজে জড়িত। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো এই পাতক্ষীরের উৎপত্তি সিরাজদিখান উপজেলার পুলিনবিহারী দেবের হাত ধরে। লিপিবদ্ধ ইতিহাস না থাকলেও মুঘল আমলে ঢাকাবাসীর খাদ্য তালিকায় পাতক্ষীরের নাম পাওয়া যায়।

    এইচএ

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    Loading…