চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘি মাঠে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় সমাবেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, দেশে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে তা শুধুই একটি সরকারের বিদায় নয়; বরং ফ্যাসিবাদবিরোধী গণচেতনার বিস্ফোরণ। তার ভাষ্য অনুযায়ী, “ফ্যাসিবাদীরা বিদায় নিয়েছে, কিন্তু ফ্যাসিবাদ বিদায় নেয়নি। ফ্যাসিবাদ কালো না লাল, বাংলার মাটিতে আর কোনো ফ্যাসিবাদ বরদাশত করা হবে না, ইনশাআল্লাহ।”
শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) বিকেলে ৮ দলীয় জোটের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বিভাগীয় গণসমাবেশে’ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। সমাবেশ ঘিরে সকাল থেকে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতাকর্মী, তরুণ, কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ এবং নারী-পুরুষের ঢল নামে লালদিঘি মাঠে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসমাগম মাঠ ছাড়িয়ে আশপাশের সড়ক ও খোলা চত্বরেও ছড়িয়ে পড়ে। সমাবেশে আসা হাজারো মানুষ লালদিঘি মাঠেই জুমার নামাজ আদায় করেন।
বক্তব্যে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, যেকোনো ব্যক্তি, দল কিংবা শক্তি যদি আবার ফ্যাসিবাদের ভাষায় কথা বলে কিংবা আচরণে সেই সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে, তবে দেশের মানুষ তা প্রতিহত করবে। তিনি বলেন, অতীতে এই জাতি নির্যাতন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, ভবিষ্যতেও প্রয়োজনে একইভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তার ভাষায়, “এই দেশের তরুণ, ছাত্র-জনতা এবং মেহনতি মানুষ আর ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি সহ্য করবে না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা অতীতেও রুখে দিয়েছিলাম, ভবিষ্যতে কেউ মাথা তুললেও রুখে দেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
তিনি দাবি করেন, আন্দোলনের লক্ষ্য কোনো নির্দিষ্ট দলের ক্ষমতায় যাওয়া নয়; বরং জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা। তিনি বলেন, “আমরা কোনো দলের বিজয় চাই না, এমনকি ৮ দলেরও বিজয় চাই না। আমরা চাই ১৮ কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিজয়। সেই বিজয় হবে কোরআনের আইনের আলোকে, ইনশাআল্লাহ।”
পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা ও মানবাধিকার ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারেনি, রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর চলছে নিপীড়ন, গুম, হত্যা ও জুলুমের রাজনীতি। তার দাবি, “দেশের টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। শুধু এক-দুই হাজার কোটি নয়, দেশ থেকে পাচার হয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা।”
বক্তব্যে তিনি সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ভেঙে ফেলা, সেনাবাহিনী ও পুলিশকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেষ্টা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার অভিযোগও করেন। তিনি বলেন, “এরা রক্ত হাতে ক্ষমতায় এসেছিল, রক্তাক্ত হাতেই বিদায় নিয়েছে।”
সমাবেশে নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম (শায়েখে চরমোনাই), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হকসহ ৮ দলের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দেন। বক্তারা বলেন, দেশের জনগণ এখন শুধু পরিবর্তন নয়, জবাবদিহিমূলক গণপ্রশাসন ও ন্যায়বিচারের রাষ্ট্র কাঠামো দেখতে চায়।
দুপুর পৌনে ২টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ শুরু হলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে লালদিঘি ও আশপাশের এলাকা পরিণত হয় রাজনৈতিক স্লোগান ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আবেগঘন বার্তার মঞ্চে। সমাবেশটি দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ এবং ভবিষ্যৎ ক্ষমতার কাঠামোকে কেন্দ্র করে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ঢাকার পর চট্টগ্রামে এমন গণসমাগম রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তির নতুন ভারসাম্য এবং সম্ভাব্য নতুন জোট কাঠামোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। সমাবেশ শেষে নেতারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
এনআই