চট্টগ্রামে লোহাগাড়া উপজেলা ভূমি অফিসকে কেন্দ্র করে যে অদৃশ্য ক্ষমতার নেটওয়ার্ক দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে। এই চক্রের মুখ্য সংযোগসূত্র হিসেবে উঠে এসেছে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর কার্যালয়ের মাস্টার রোলে কর্মরত সরকারি ড্রাইভার শাহ আলমের নাম।
সাধারণ চালকের জীবন থেকে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আনুমানিক দুই কোটি টাকা মূল্যের আলিশান দালান-কোঠার মালিক হওয়া, স্কেভেটর ও ডাম্পারসহ একাধিক ভারী যন্ত্রপাতির অধিকারী হয়েছেন তিনি।
একই সঙ্গে অবৈধ বালু-মাটি উত্তোলনকারী সিন্ডিকেটের ‘আগাম সতর্কবার্তাদাতা’ হিসেবে ভূমিকা রাখার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে বিষয়টি এখন স্থানীয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য এক গভীর অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় সূত্র ও অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, শাহ আলম লোহাগাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিল্যাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তার পিতা আইয়ুব পেশায় গাড়িচালক ছিলেন। পারিবারিকভাবে তারা কখনোই বিত্তশালী ছিলেন না। জীবিকার সন্ধানে ২০০৮ সালে শাহ আলম মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান।
প্রায় পাঁচ বছর প্রবাসে অবস্থান করলেও উল্লেখযোগ্য আর্থিক সাফল্য অর্জন করতে না পেরে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে বাবার বদলি চালক হিসেবে মাঝেমধ্যে গাড়ি চালানোই ছিল তার মূল আয়ের উৎস। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত তার জীবনযাত্রায় কোনো আর্থিক স্বচ্ছলতার চিহ্ন ছিল না।
এরপর স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলে তিনি তাঁতী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন শাহ আলম। রাজনৈতিক পরিচয়ের সুবাদে ধীরে ধীরে প্রশাসনিক অন্দরমহলে তার যাতায়াত ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। স্থানীয়দের মতে, এই সময় থেকেই তার চলাফেরা, যোগাযোগ ও আর্থিক সক্ষমতায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়।
অভিযোগ আছে, প্রথমে তিনি অবৈধ মাটি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। পাহাড় ও কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে বিক্রির মাধ্যমে দ্রুত অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করেন। একাধিক প্রশাসনিক অভিযানে সেই উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হলেও এতে তার যোগাযোগের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়। স্থানীয়দের মতে, এখান থেকেই তিনি বুঝে যান, সরাসরি ব্যবসার চেয়ে প্রশাসনিক তথ্যই সবচেয়ে বড় শক্তি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবু রেজা নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজার সুপারিশে লোহাগাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর তৎকালীন চালককে সরিয়ে মাস্টার রোলের ভিত্তিতে শাহ আলমকে ২০০১ সালে সরকারি ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগের মধ্য দিয়েই তিনি সরাসরি ভূমি প্রশাসনের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ পান।
অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্বের সুযোগ নিয়ে শাহ আলম নিয়মিতভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত, অবৈধ বালু-মাটি উত্তোলনবিরোধী অভিযান ও প্রশাসনিক তৎপরতার আগাম তথ্য সংশ্লিষ্ট চক্রের কাছে পৌঁছে দিতেন। এসব তথ্য রাতের আঁধারে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে পাচার হতো। বিনিময়ে প্রতিটি সিন্ডিকেট সদস্যের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ আদায় করা হতো বলে স্থানীয়দের দাবি।
এই অবৈধ অর্থের জোরেই শাহ আলম লোহাগাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিল্যাপাড়ায় একটি আলিশান দালান-কোঠা নির্মাণ করেছেন, যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। পাশাপাশি তার মালিকানায় স্কেভেটর, ডাম্পারসহ একাধিক ভারী যন্ত্রপাতি রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে, যা একজন মাস্টার রোলের সরকারি ড্রাইভারের বৈধ আয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, তথ্য পাচারের কাজে একটি গোপন মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হতো। সেই নম্বরের মাধ্যমে বার্তা পৌঁছাত তার এক বেয়াইয়ের কাছে। সেখান থেকেই অবৈধ বালু ও মাটি উত্তোলনকারী চক্রকে সতর্ক করা হতো। ফলে অধিকাংশ প্রশাসনিক অভিযান শুরুর আগেই এলাকা ফাঁকা করে ফেলত চক্রগুলো। এ কারণেই লোহাগাড়ায় একের পর এক অভিযান ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
শুধু এসিল্যান্ডের গাড়ি নয়, অনেক সময় শাহ আলম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)-এর গাড়িও চালানোর সুযোগ পেতেন বলে দাবি স্থানীয়দের। গভীর রাতে ইউএনও বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিযানে বের হলে চালকের আসন থেকেই অভিযানের সময়, রুট ও লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। স্থানীয়দের মতে, এই কারণেই অবৈধ বালু-মাটি উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে পরিবেশ ও কৃষিতে। চুনতি, পুটিবিলা, চরম্বা ও কলাউজান এলাকায় বর্তমানে অন্তত অর্ধশতাধিক অবৈধ বালু ও মাটি উত্তোলনকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। পাহাড়, টিলা ও উর্বর কৃষিজমি নির্বিচারে কেটে নেওয়ায় পরিবেশগত ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, এসব অনিয়ম বহুবার প্রশাসনকে জানানো হলেও কার্যকর ও স্থায়ী ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।
আইনজ্ঞদের মতে, একজন মাস্টার রোলে কর্মরত সরকারি ড্রাইভারের হাতে যদি প্রশাসনিক অভিযানের আগাম তথ্য থাকে এবং তা অবৈধভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে সেটি শুধু ব্যক্তিগত দুর্নীতি নয়, এটি প্রশাসনিক নিরাপত্তা ও জবাবদিহির গুরুতর ব্যর্থতার প্রতিফলন। দণ্ডবিধি ও দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের আওতায় স্বাধীন তদন্ত এখন সময়ের দাবি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে শাহ আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তাঁর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ক্ষুদে বার্তারও কোনো জবাব মেলেনি।
অন্যদিকে, এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে লোহাগাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মং এছেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ড্রাইভার শাহ আলমের অভিযোগ পুরোপুরি না শুনেই তাড়াহুড়ো করে সময়ের কণ্ঠস্বর-কে বলেন, ‘আপনারা আমাকে লিখিত অভিযোগ দিন। অভিযোগের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এটাই আমার বক্তব্য।’ এরপর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
আরডি