কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদে এবার ১১ কোটি ৭৮ লাখ ৪৮ হাজার ৫৩৮ টাকা পাওয়া গেছে। এছাড়াও দানবাক্সে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গেছে। প্রায় সাড়ে ১০ ঘণ্টা ধরে ৬০০ জনের একটি দল এই অর্থ গণনার কাজ সম্পন্ন করেন।
শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৭টায় দানবাক্সগুলো খোলা হয়। পরে সকাল ৯টার দিকে সেগুলো মসজিদের দোতলায় গণনার জন্য নেওয়া হয়। দিনভর টাকা গণনা শেষে সন্ধ্যা পৌনে ৮টার দিকে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
এবার ৩ মাস ২৭ দিন পর সকালে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা ও পুলিশ সুপার ড. এস এম ফরহাদ হোসেনের উপস্থিতিতে মসজিদের ১৩টি লোহার দানবাক্স খোলা হয়। এতে মোট ১১ কোটি ৭৮ লাখ ৪৮ হাজার ৫৩৮ টাকা পাওয়া গেছে। এসব বস্তাভর্তি টাকা গণনার কাজে অংশ নেয় মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পার্শ্ববর্তী জামিয়া এমদাদিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থী, রূপালী ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মাচারীসহ প্রায় ছয় শতাধিক মানুষের একটি দল।
এর আগে গত ৩০ আগস্ট কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের ১৩টি দানবাক্স থেকে রেকর্ড ১২ কোটি ৯ লাখ ৩৭ হাজার ২২০ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। সে সময়ও বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া যায়।
জানা গেছে, প্রতি তিন মাস পরপর দানবাক্সগুলো খোলা হলেও এবার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থতির কারণে সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। দানবাক্সে পাওয়া টাকার পরিমাণ এবার অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন এ মসজিদে দান করেন। যারা দান করতে আসেন তারা বলে থাকেন, এখানে দান করলে মনোবাসনা পূরণ হয় এমন বিশ্বাস থেকে তাঁরা ছুটে আসেন।
এ মসজিদের দানবাক্সে যে বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়, তা জেলার আর কোনো মসজিদে পাওয়া যায় না। টাকার সঙ্গে সোনা-রুপার অলংকারসহ থাকে বিদেশি মুদ্রাও। তা ছাড়া প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, ফলফলাদি, মোমবাতি ও ধর্মীয় বই দান করে লোকজন। আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় দানবাক্সে পাওয়া চিঠিপত্র। এসব চিঠিতে লোকজন তাঁদের জীবনে পাওয়ার আনন্দ, না পাওয়ার বেদনা, আয়-উন্নতির ফরিয়াদ, চাকরির প্রত্যাশা, পরীক্ষায় ভালো ফলের আশা ও রোগব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে আকুতি প্রকাশ করেন। এমনকি শত্রুকে ঘায়েলের দাবিও থাকে কোনো কোনো চিঠিতে।
বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ মসজিদে মানত নিয়ে আসা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের ঢল নামে। আগতদের মধ্যে মুসলিমদের অধিকাংশই জুমার নামাজ আদায় করেন মসজিদে। আর এ ইতিহাস প্রায় আড়াইশ বছরেরও অধিক সময়ের বলে জানা যায়।
মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা গেছে, জেলা শহরের নরসুন্দা নদীর তীরে এ মসজিদের অবস্থান। প্রাপ্ত দানের টাকা থেকে পাগলা মসজিদ এবং এই মসজিদ কমপ্লেক্সের অন্তর্ভুক্ত মাদ্রাসা, এতিমখানা ও কবরস্থানের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানায় সহায়তা করা হয়। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজেও এই ফান্ড থেকে টাকা খরচ করা হয়।
মসজিদটিতে এবার আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দ্রুত এর কাজ শুরু হবে। যার নামকরণ হবে ‘পাগলা মসজিদ ইসলামিক কমপ্লেক্স’। এটি নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। সেখানে ৬০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন।
পুলিশ সুপার ড. এস এম ফরহাদ হোসেন বলেন, সকাল থেকে টাকার সিন্দুক খোলা, বস্তায় ভরে এনে গণনা শেষে ব্যাংক পর্যন্ত সব টাকা নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সার্বিক নিরাপত্তার কাজে তিনিসহ পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন।
জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা বলেন, মসজিদের দান থেকে পাওয়া এসব অর্থ সংশ্লিষ্ট মসজিদসহ জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা ও এতিমখানার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় হয়। মসজিদটিকে আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দ্রুতই এর কাজ শুরু হবে। যার নামকরণ হবে ‘পাগলা মসজিদ ইসলামিক কমপ্লেক্স’। এটি নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ থেকে ১২০ কোটি টাকা। সেখানে ৬০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন।
প্রসঙ্গত, গত ১০ আগস্ট রোববার সকালে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ পরিদর্শনে আসেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্ঠা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, খুব শিগগিরই দৃষ্টিনন্দন পাগলা মসজিদের ১০ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হবে। আধুনিক তুরস্কের নকশায় বহুমুখী কার্যক্রম সম্পাদনের উপযোগী ইসলামিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হবে।
তিনি আরও বলেন, পাগলা মসজিদের দানবাক্স থেকে পাওয়া সব টাকা মসজিদের ১৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এফডিআর হিসেবে রাখা আছে, যা থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ গরিব, অসহায়, অনাথ ও অসুস্থদের জন্য ব্যয় করা হয়।
এসময় তিনি প্রস্তাব করে বলেন, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে এই তহবিল থেকে সহায়তা দেওয়ার। এতে শিক্ষার সুযোগ বাড়বে।
উপদেষ্ঠা আশা প্রকাশ করে বলেন, অন্তবর্তীকালীন সরকারের মেয়াদের মধ্যেই দৃষ্টিনন্দন পাগলা মসজিদের ১০ তলা ভবন নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে।
এনআই