টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির কার্যক্রম বর্তমানে কার্যত সভাপতি হাসানুজ্জামিল শাহীন ও সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবালের হাতেই সীমাবদ্ধ। দীর্ঘ তিন বছর পেরিয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি, যা দলের ভেতরে গলদ, অস্থিরতা ও বিভাজনকে তীব্র করেছে। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী এক মাসের মধ্যে কমিটি দেওয়ার কথা থাকলেও সময়ের পরিধি ছাড়িয়ে গেছে তিন বছর। চলতি বছরের ১ নভেম্বর এই কমিটির মেয়াদও শেষ হয়েছে। এতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘ ১৩ বছর পর ২০২২ সালের ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হন হাসানুজ্জামিল শাহীন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ফরহাদ ইকবাল। সেই সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও অনলাইনে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন। সেদিন কেন্দ্রীয় নেতারা এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে কেন্দ্রে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে- কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আযম খানের অনুসারীদের প্রাধান্য দিয়ে দেড় বছর পর সভাপতি হাসানুজ্জামিল শাহীন ও সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি চূড়ান্ত করে কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন, তা জেলা পর্যায়ের বিভক্তি, আযম-বিরোধী দ্বন্দ্ব এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের অনাগ্রহের কারণে অনুমোদন পায়নি। এর মধ্যেই কমিটির মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। ফলে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে।
জেলা বিএনপির অন্তত এক ডজন নেতার ভাষ্যে, তিন বছরে দু’জন নেতার বাইরে টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির আর কোনো কার্যকর নেতৃত্ব নেই। সিদ্ধান্ত, সমন্বয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মসূচি সবই ছিন্নভিন্ন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলীয় কার্যালয় সংকট। জেলায় বহু বছর ধরে বিএনপির নিজস্ব কোনো দলীয় কার্যালয় নেই। ফলে কতিপয় নেতারা ব্যক্তিগত অফিসে বসে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এতে যোগাযোগ, কর্মসূচি বাস্তবায়ন, উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয়সহ নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ নিয়ে জেলাজুড়ে ক্ষোভ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। নেতাকর্মীরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকা দলকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
সম্প্রতি সবচেয়ে বড় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনে। দলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগপন্থীদের প্রভাবিত করার অভিযোগ এনে উপজেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৩৩ নেতা পদত্যাগ করেছেন- এমন তথ্য পাওয়া গেলেও জেলা সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল দাবি করেন, মাত্র চারজন পদত্যাগ করেছেন এবং সেগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। তবে স্থানীয় নেতারা বলছেন, জেলার নেতাদের সমন্বয়ের অভাবে ঘটনাটি এলাকায় বড় ধরনের অনাস্থা ও বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।
অব্যাহতি পাওয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান সাজু সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, জেলা বিএনপির সভাপতি, সম্পাদককে এ বিষয়টি অবহিত করা হলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেননি। বরং তারাও আযম খানের পক্ষে অবস্থান নেন।
অন্যদিকে মনোনয়ন ইস্যুতেও বেশিরভাগ আসনেই বিভক্তি দেখা দিয়েছে। জেলার আটটি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে বিএনপির মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন দলের নেতাকর্মীদের একাংশ। মনোনয়ন পরিবর্তন না হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ারও ইঙ্গিত দিয়েছেন কেউ কেউ। ইতোমধ্যে অনেক সম্ভাব্য প্রার্থী তাদের অনুসারীদের নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এসকল কিছুর পেছনে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকাকে দায়ী করছেন অনেকেই।
জেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, টাঙ্গাইলের মতো বৃহৎ জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। তাদের ভাষ্য, তিন বছরে দু’জন নেতা ছাড়া আর কেউ নিজেদের পরিচয় পর্যন্ত দিতে পারছে না, এতে নেতাকর্মীদের মাঝে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
জেলা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছাইদুল হক ছাদু সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, "জেলা কমিটি সাধারণত ১০১ অথবা ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট হয়। কিন্তু এই দুইজন ছাড়া তিন বছরে কেউ তাদের দলীয় পরিচয় দিতে পারেনি। এতে নেতাকর্মীরা সবাই হতাশাগ্রস্থ ও ক্ষুব্ধ। আমরা সবাই দেশনায়ক তারেক রহমানের দিকে তাকিয়ে আছি। উনার সিদ্ধান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত। তবে নির্বাচনের আগে যেকোনো একটা সিদ্ধান্তে আসা উচিৎ বলে আমি মনে করি। কারণ জেলা বিএনপির বর্তমান সাংগঠনিক চিত্র এক কথায় ‘হযবরল’।"
জেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব মাহমুদুল হক বলেন, 'বর্তমান শাহীন-ফরহাদের কমিটির অন্তরালে ছিল আহমেদ আযম খান। এই দু’জন তাদের নিজেদের স্টাইলে কার্যক্রম করেছে। একটা সাংগঠনিক কমিটি হিসেবে যা করার কথা ছিল, তা তারা কিছুই করেননি। একতরফাভাবে কেন্দ্রীয় কমিটিকে দেখানোর জন্য ফটোসেশনের মাধ্যমে দলীয় প্রোগ্রামগুলো করেছে। এতে টাঙ্গাইলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।'
তাঁর ভাষ্য, মাঠ পর্যায়ে এখন এমন পরিস্থিতি যে কেউ কারও কথা শুনছে না; নিয়ন্ত্রণহীন একটি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে জেলা বিএনপি। ১২ জন কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছে এখানে, তিনজন ভাইস চেয়ারম্যান। তাদেরকেও একাধিকবার বলেছি নির্বাচনের আগে দলটাকে গোছানোর জন্য, কিন্তু কে শোনে কার কথা? যার যার মতে কার্যক্রম চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় টাঙ্গাইলে মনোনয়ন ইস্যুতে বিভিন্ন স্থানে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে। মিছিল-মিটিং চলছে। এককথায় কঠিন অবস্থার মধ্যে টাঙ্গাইল জেলা রয়েছে।
দীর্ঘদিনেও কমিটি না দিতে পারাটা সাংগঠনিক দুর্বলতা বলে মনে করেন সিনিয়র এ রাজনীতিবিদ। তিনি বলেন, 'দ্রুত এই কমিটি ভেঙে দিয়ে একটি প্রস্তুতি কমিটি বা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দল পরিচালনা করা উচিত, তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভালো ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। আর যদি এই অবস্থা থাকে, তাহলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে।'
অন্যদিকে জেলা সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, 'কমিটি না হওয়ার দোষ তাদের নয়, প্রায় ১৫ মাস আগে কমিটি সেন্ট্রালে জমা দেওয়া হয়েছে। সেখানে আমাদের ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে, সেটা কেন্দ্র সংশোধন করে দিতে পারত।'
জেলা বিএনপিতে মনোনয়ন ইস্যুতে গ্রুপিং নেই দাবি করে তিনি বলেন, 'দল যদি মনে করে নির্বাচনের আগে পুনর্গঠন করা ভালো, সেটি স্বাগত। কোনো সমস্যা নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি নির্বাচনের আগে কমিটি করার সুযোগ নেই। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে প্রোগ্রাম করছে। এখন দল নির্বাচন নিয়েই ব্যস্ত। কমিটি দিয়ে কি আবার আরেকটা গ্রুপিং তৈরি করবে?'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, 'কয়েকটি জেলায় কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে, এর মধ্যে টাঙ্গাইল একটি। এ জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। তবে এরইমধ্যে নির্বাচনের ডামাঢোল শুরু হওয়ায় এই মুহূর্তে কোনো কমিটি নিয়ে সময় দিতে পারছি না।'
দু'জনের কমিটি দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব হবে না, নেতাকর্মীদের এমন দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, 'অনেকে আমাদেরকেও বলেছেন। বিষয়টি বিবেচনাধীন আছে। হয়তো নির্বাচনের কারণে ওই দিকে নজর দিতে পারছি না। তবে অবস্থা বুঝে যেখানে পূর্ণাঙ্গ কমিটি বা নতুন কমিটি দরকার মনে হবে, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। বিষয়টি একেবারেই অসম্ভব না।'
এসকে/আরআই/পিএম