দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার ২৪ দিন পেরিয়ে গেলেও একাট্রা হতে পারেনি যশোরের শার্শা বিএনপি। প্রার্থিতা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার পরপরই মফিকুল হাসান তৃপ্তি উপজেলা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে হতাশা, অভিমান আর ইগোয় ভুগছেন যশোর-১ (শার্শা) আসনে মনোনয়ন না পাওয়া বিএনপির দুই নেতার অনুসারীরা। সেকারণে এখন পর্যন্ত সংগঠিত আকারে নির্বাচনী প্রচারণায় যেতে পারেনি দলটি। এই অবস্থার অবসান না ঘটলে আখেরে খেসারত দিতে হতে পারে বিএনপিকে-এমনটিই বলছেন তাদের ভোটাররা।
জানা যায়, মনোনয়ন ঘোষণার পর তৃপ্তি প্রতিদিন তৃণমূলে উঠান বৈঠক, গণসংযোগ ও সংগঠন পুনরুজ্জীবনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে মাঠে রয়েছেন উপজেলা ও পৌর বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী, বিভিন্ন ওয়ার্ড কমিটির সক্রিয় সদস্য এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোগীরা। কিন্তু যারা উপজেলার নেতৃত্বে আছেন-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই নীরব। দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তারা তৃপ্তির প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন না। সমাবেশ আয়োজন, কর্মিসভা, সমন্বয় বৈঠক কিংবা সংগঠনের নিয়মিত কার্যক্রম কোথাও তাদের উপস্থিতি নেই।
এ অবস্থায় তৃপ্তির প্রচারণায় এক ধরনের অস্বচ্ছতা তৈরি হয়েছে, যা তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। তবে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী মফিকুল হাসান তৃপ্তি এর জনসংযোগে সমর্থন দিনে দিনে বড় আকার ধারন করছে।
ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা যশোর-১ (শার্শা) আসনটি বরাবরই একটু আলাদা তাৎপর্যপূর্ণ। একসময় আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনটিতে বরাবরই সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের নেতারাই নির্বাচিত হয়েছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগ সাতবার, বিএনপিও তিনদফা জিতেছে, একবার করে বিজয়ী হন জামায়াত ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে সেই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে, পালিয়েছেন এই আসনের চারবারের এমপি শেখ আফিলউদ্দিনও।
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে মূল লড়াই হবে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীর মধ্যে এটা নিশ্চিত। দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করা এবং দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে শার্শা-১ আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি তাদের দলীয় প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণা করেছে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক সংসদ-সদস্য মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে। আর নির্বাচনী ডামাডোল শুরুর আগেই জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয় এই আসনে একবার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমানকে।
শার্শা-১ আসনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি ছাড়াও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছিলেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হাসান জহির, সাধারণ সম্পাদক নূরুজ্জামান লিটন এবং সাবেক আহ্বায়ক ও উপদেষ্টা খায়রুজ্জামান মধু।
গত ৩ নভেম্বর দলের মহাসচিব ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে যশোরের ছয়টির মধ্যে পাঁচটি আসনে বিএনপি প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে যশোর-১ আসনে আসে মফিকুল হাসান তৃপ্তির নাম। স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি অংশ তৃপ্তির নাম ঘোষণায় খুশি হতে পারেননি। তাদের অভিযোগ, দলের দুঃসময়ে তৃপ্তি রাজপথে ছিলেন না। যারা বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনামলে জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, রাজপথের আন্দোলনকে বেগবান করেছেন, দল হয়তো তাদের মূল্যায়ন করবে। সেকারণে তাদের মধ্যে কিছুটা হতাশার জন্ম নেয়।
তেমনই কথা উঠে এসেছে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হাসান জহিরের কণ্ঠেও। গত ৫ নভেম্বর বিকেলে তার অনুসারীদের নিয়ে গণজমায়েত করেন জহির। দলের উপজেলা কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত গণজমায়েতে আবুল হাসান জহির তার অনুসারী বিএনপির নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনারা হতাশ হবেন না, শান্ত থাকুন। বিশ্বাস করি, দল অবশ্যই মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করবে।’
আলাপকালে আবুল হাসান জহির বলেন, ‘দীর্ঘ ১৭ বছর রাজপথের সংগ্রামে ছিলাম। নেতাকর্মীদের সুখে-দুখে পাশে রয়েছি। সঙ্গত কারণেই তাদের মন খারাপ। ঢাকায় থাকাকালে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা হয়। এরপর থেকে নেতাকর্মীরা ফোনে কান্নাকাটি করেছে। আমি তাদের সান্তনা দিয়েছি মাত্র। দল যাকে যোগ্য মনে করবে, তাকেই মনোনয়ন দেবে। তবে, একটি কথা আশাজাগানিয়া। মহাসচিব বলেছেন, ‘এটি সম্ভাব্য, চুড়ান্ত নয়’। সেকারণে পরিবর্তন হতেও পারে বলে তাদের ধারনা।’
পুনর্বিবেচনা না হলে কী করবেন জানতে চাইলে জহির বলেন, ‘ব্যক্তিবিশেষ হয়তো অপছন্দের হতে পারে। কিন্তু মার্কার কাছে সেগুলো টিকবে না। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ধানের শীষের পক্ষেই থাকবেন। খুব শিগগির কমিটি বসে আমরা প্রচার-প্রচারণার সিদ্ধান্ত নেবো।’
এ বিষয়ে জানতে দলের সাধারণ সাধারণ সম্পাদক নূরুজ্জামান লিটন অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী। তিনি কোন কথা বলতে চাননি।
এদিকে, মনোনয়ন ঘোষণার পরপরই মফিকুল হাসান তৃপ্তি ওই রাতেই শার্শার বাগআঁচড়া ইউনিয়নের সনাতনকাটি গ্রামে মা-বাবা ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের কবর জিয়ারত করেন। ওইসময় সহস্রাধিক সমর্থকের উপস্থিতিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
জানতে চাইলে মফিকুল হাসান তৃপ্তি বলেন, ‘মনোনয়ন পেয়েই দলের উপজেলা সভাপতি ও পরে সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করেছি। জননেতা তরিকুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছি একসাথেই।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপি অনেক বড় রাজনৈতিক দল। আমাদের অনেক নেতা রয়েছেন মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু দল সবাইকে তো দিতে পারবে না। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবে। যারা মনোনয়ন পাননি, পরবর্তীতে তাদের জন্যে দল অবশ্যই অন্যকিছু বিবেচনা করবে। তবে, ধানের শীষের ক্ষেত্রে আমরা সবাই এক এবং ঐক্যবদ্ধ।’
বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে মাত্র হাজার পাঁচেক ভোটে হারেন জামায়াতের প্রার্থী। এই আসনে একক প্রার্থী হিসেবে জামায়াত জোরেশোরে প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু, বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে এখনো প্রচারণা খুব একটা সংগঠিত নয়। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে নির্বাচনে খেসারত দিতে হতে পারে বলে বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা মনে করেন। এর ফলে এ আসনে দলের মনোনীত প্রার্থী নিজ দলের মনোনয়নবঞ্চিত নেতা ও তাদের অনুসারীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
বিএনপির উপজেলা পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, দল যাকে যোগ্য মনে করেছে তাকে মনোনীত করেছে। দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েই আমরা কাজ করছি। কিন্তু বঞ্চিত নেতা ও তাদের অনুসারীরা দলের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সভা-সমাবেশে দলের মনোনীত প্রার্থীদের অযোগ্য প্রমাণের জন্য নানা বিতর্কিত বক্তব্য রাখছেন। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রকারান্তে বিএনপির ভাবমূর্তিই ক্ষুন্ন হচ্ছে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সমালোচনার রসদ জোগাচ্ছেন দলের বিদ্রোহীরা।
এ বিষয়ে বেনাপোল পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের বলেন, আমরা মফিকুল হাসান তৃপ্তির সঙ্গে আছি। তিনি আমাদের দলীয় প্রার্থী। আমাদের দায়িত্ব সব ধরনের সমর্থন দিয়ে তাকে এগিয়ে নেওয়া। আশা করি উপজেলা নেতৃত্বও দ্রুত একই প্ল্যাটফর্মে ফিরে দলকে শক্তিশালী করবে।
যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, দল যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সেটাই কার্যকর হবে। তবে তারা (উপজেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) প্রার্থিতা চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি। একটু মানসিক কষ্টে থাকা স্বাভাবিক। কদিন গেলে আমরা বিষয়টি ঠিক করে নেব।
বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, সেরা প্রার্থী হিসাবেই দলের মনোনীতদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এসব আসনে অনেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। দলে তাদের অনেক অবদান আছে। দল তাদের অবদান স্বীকারও করে। বঞ্চিতরা নিজেদের যোগ্য মনে করে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবি জানাতেই পারেন। তবে সেটি সাংগঠনিক ও সুশৃঙ্খল হতে হবে। এমন কিছু করব না, যাতে মানুষের কাছে দল সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যায়। দলের বিবেচনায় চুড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় সংশোধনীও আসতে পারে। সেটি দলের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
তিনি বলেন, জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে মনোনীত প্রার্থী ও মনোনয়নবঞ্চিতদের ডেকে করণীয় সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। আমরা মনে করি, কারও না পাওয়ার কষ্ট থাকতে পারে, কিন্তু দিনশেষে সবাই ধানের শীষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এবার জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমান। তিনি দলের পক্ষে এই আসন থেকে ২০০৮ সালে প্রথম নির্বাচন করেছিলেন।
মাওলানা আজীজুর রহমান বলেন, ‘সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ আমাকে বলেছেন, তারা শান্তি, নিরাপত্তা আর ঝামেলামুক্ত থাকতে চান।’
আওয়ামী লীগের ভোটারদের সম্পর্কে তার ম্যূলায়ন, দল হিসেবে তারা কী সিদ্ধান্ত নেবেন জানি না, কিন্তু অনেক আওয়ামী সমর্থক ভোটাররা আশ্বাস দিয়েছেন। রাজনীতিতে সৎ মানুষ নেতৃত্বে আসুক তারা সেটা চান।
এই আসনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী হয়েছেন দলের শার্শা উপজেলা সভাপতি মাওলানা মাহাবুবুর রহমান এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী দলের শার্শা উপজেলা সভাপতি বখতিয়ার হোসেন।
একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গঠিত শার্শা উপজেলা যশোর-১ আসন। এ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৩৮ হাজার ৩৩৯ জন। যার মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৭১ হাজার পাঁচ এবং নারী ভোটার এক লাখ ৬৭ হাজার ৩৩১ জন ও তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) ভোটার ৩ জন।
আরডি