এইমাত্র
  • কিছুটা ‍কমেছে সবজির দাম, চড়া তেল-পেঁয়াজ
  • মুক্ত হয় উত্তর-পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা
  • ঝিনাইদহে নসিমন চালককে কুপিয়ে হত্যা
  • দেশে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের আভাস
  • যশোরে পোষা কুকুর-বিড়ালে আক্রান্ত বাড়ছে, টিকা সংকট
  • সব ঠিক থাকলে খালেদা জিয়াকে লন্ডন নেওয়া হবে রোববার
  • নওগাঁয় মাদকসহ ১ জন গ্রেপ্তার
  • বিএনপির মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে অগ্নিসংযোগ-বিক্ষোভ-সড়ক অবরোধ
  • নোয়াখালী প্রেসক্লাবে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় দোয়া
  • ঢাকার পথে ডা. জুবাইদা রহমান
  • আজ শুক্রবার, ২১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ | ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
    ফিচার

    কক্সবাজারের জন্মের সাক্ষী যেই বাড়ি

    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৪০ এএম
    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৪০ এএম

    কক্সবাজারের জন্মের সাক্ষী যেই বাড়ি

    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৪০ এএম

    বাংলাদেশের ভ্রমনপিপাসু মানুষদের স্বর্গ বলা হয় কক্সবাজারকে। সমুদ্র আর পাহাড়ঘেরা একসময়ের পালংকি শহরই আজকের কক্সবাজার। এই শহরের জন্মকথা যতটা রোমাঞ্চকর, ততটাই বিস্ময়কর। ১৭৮৪ সালে আরাকান দখল করে নেওয়ার পর বার্মার রাজা বোধাপায়ার অত্যাচার থেকে বাঁচতে প্রায় ১৩ হাজার আরাকানি জনতা পালিয়ে আসে তৎকালীন পালংকীতে।

    সেই সময়ে এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের পুনর্বাসন ছিল ব্রিটিশ শাসকদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দায়িত্ব দেয় ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে। তিনি শুধু কূটনীতিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন সজ্জন প্রশাসকও- যাকে ঘিরেই কক্সবাজারের নামের জন্ম।

    কক্সবাজার নামের উৎপত্তি:

    পালংকীতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের পুনর্বাসন কার্যক্রম চালাতে গিয়ে হিরাম কক্স এখানে গড়ে তোলেন একটি বাজার। প্রথমে এটি পরিচিত ছিল ‘কক্স সাহেবের বাজার’ নামে। সময়ের ধারাবাহিকতায় তা হয়ে ওঠে ‘কক্স-বাজার’, পরে ‘কক্সবাজার’। এই অঞ্চল একসময় পরিচিত ছিল ‘প্যানোয়া’ নামেও- যার অর্থ হলুদ ফুলের দেশ। সত্যিই, তখন কক্সবাজার ছিল হলুদ ফুলের রাজ্য।

    যে বাংলো বাড়িতে থাকতেন কক্স সাহেব:

    শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কাজে পালংকীতে ব্যস্ত থাকলেও রাত কাটানো কিংবা দাপ্তরিক কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল স্থায়ী আবাসনের। সেই কারণেই রামুর যে বাংলোবাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে আছে- সেটিই ছিল ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের থাকার জায়গা। প্রায় ২২০ বছরের পুরনো এই বাংলোটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৯০-এর দশকে।

    ১৭৯৯ সালে এখানেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ক্যাপ্টেন কক্স। তার মরদেহ নিতে চকরিয়ার মেধাকচ্ছপিয়া এলাকার বড়খালে জাহাজ নিয়ে এসেছিলেন তার স্ত্রী ম্যাডাম কক্স পিয়ার। লোকমুখের প্রচলন অনুসারে, ‘ম্যাডাম কক্স পিয়ার’ নামটি ঘুরে ঘুরে হয়ে ওঠে মেধাকচ্ছপিয়া, যা এখন দেশের অন্যতম জাতীয় উদ্যান।

    এক বাংলো, ৩০ বছরের প্রহরী:

    রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের অফিসের চর এলাকায় এই বাংলোটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কক্সবাজার শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। এখানেই আছেন ৫৫ বছর বয়সী বদিউজ্জামান, যিনি গত ৩০ বছর ধরে পাহারা দিচ্ছেন কক্স সাহেবের বাংলো। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এ বাড়ির প্রকৃত ইতিহাস অনেকেই জানেন না।

    দুই কক্ষবিশিষ্ট বাংলো ঘরটিতে এখনো আছে ব্রিটিশ আমলের খাট, চেয়ার-টেবিল। সরকারি কর্মকর্তা চাইলে রাত যাপন করতে পারেন ২০০ টাকায়; সাধারণ পর্যটকদের জন্য খরচ ৪০০ টাকা।

    দীর্ঘ অবহেলার পর নতুন পরিচয়:

    একসময় কেউ খোঁজও নিত না বাংলোটি। নেই স্মৃতিফলক, নেই ইতিহাসের কোনো চিহ্ন। কেবল ‘জেলা পরিষদ বাংলো’ নামে পরিচিত ছিল। অযত্নে-অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল ২২২ বছরের এই স্থাপনা। কিন্তু সংবাদকর্মী ও স্থানীয় নাগরিকদের দাবির মুখে বিষয়টি নজরে আসে প্রশাসনের। রামু উপজেলা প্রশাসন বাংলোটি সংস্কার করে দেয় এবং নতুন নামকরণ করে- ‘কক্স সাহেবের বাংলো’। সংস্কারের পর পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে কয়েকগুণ।

    ইতিহাস বলে, হিরাম কক্স ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের কূটনীতিক। পালংকি অঞ্চলের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কাজ। আরাকান শরণার্থী ও স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু দায়িত্ব শেষ না করেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে পুরো জেলার নামকরণ করা হয়েছে কক্সবাজার।

    সংস্কারের পর এখনই প্রথম বার বাংলোটি নিজের পরিচয় পেয়েছে। রাস্তার পাশেই বড় সাইনবোর্ড- ক্যাপ্টেন কক্সের ছবি খচিত। সবুজ গাছের ছায়া, নিস্তব্ধতার আবেশ আর ইতিহাসের গন্ধ- দর্শনার্থীদের মন ছুঁয়ে যায়।

    ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে স্থাপিত স্মৃতিফলক- যেখানে তুলে ধরা হয়েছে ক্যাপ্টেন কক্সের জীবনী, বাংলোর নির্মাণকাল ও কক্সবাজার নামের উৎপত্তির বিবরণ।

    ৩০ বছরের প্রহরী বদিউল আলম বললেন, ‘আগে এই বাড়ি কেউ দেখতে আসতো না। এখন নামকরণ হওয়ার পর দর্শনার্থী অনেক বেড়েছে।’

    চট্টগ্রাম থেকে ঘুরতে আসা কয়েকজন তরুণ বলেন, ‘ইতিহাস জানতেই আসা। এত গুরুত্বের জিনিস আগে জানতাম না। এখানে দাঁড়ালে মনে হয় সময় যেন পেছনে ফিরে যাচ্ছে।’

    স্থানীয় শিক্ষক শহিদুল্লাহ বলেন, ‘এই বাংলোয় হিরাম কক্স দীর্ঘদিন বাস করেছেন। কিন্তু সেই ইতিহাস লুকিয়ে ছিল। এখন নতুন প্রজন্ম জানছে, এটাই বড় অর্জন।’

    ইতিহাসের পথে হাঁটতে চাইলে…

    রামু চৌমুহনী স্টেশন থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দক্ষিণে রামু-মরিচ্যা আরাকান সড়কের পশ্চিম পাশে নজর কাড়বে বাংলোটি। গাছ-গাছালির আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাড়িতে যেন থমকে আছে সময়। ক্যাপ্টেন কক্সের স্মৃতি, ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্য, আরাকান শরণার্থীদের ইতিহাস- সব মিলিয়ে বাংলোটি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান।

    স্থানীয়দের মতে, কক্সবাজারের সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলতে গেলে সমুদ্রের নীল বিস্তার ছাড়া আর কিছুই তেমন মনে আসে না আমাদের। কিন্তু এই শহরের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হিরাম কক্সের বাংলোবাড়ি- যেখানে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অধ্যায়। সংস্কারের পর এখন বাংলোটি যেন নিজের পরিচয় ফিরে পেয়েছে। সময় বলবে- এখন থেকে কক্সবাজারের পর্যটন মানচিত্রে এই বাংলোবাড়ি কতটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়।

    জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘হিরাম কক্সের অবদানের কারণেই কক্সবাজারের নামকরণ। বাংলোটিকে ইতিহাসের অংশ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে- এটি জেলার ঐতিহ্যে এক নতুন সংযোজন।’

    আরডি

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    চলতি সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

    Loading…