সংবিধান, আইন ও নীতিমালায় নারী-পুরুষের সমতার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে সম্পত্তিতে সমঅধিকার নিশ্চিত হয়নি এখনো। বিশেষ করে পৈত্রিক জমির ক্ষেত্রে নারীরা নানাভাবে বঞ্চিত হন। পরিবারে অসন্তোষের ভয়, ভুল সামাজিক বিশ্বাস এবং আইনি জটিলতার কারণে অনেক নারী নিজেদের ন্যায্য অংশ দাবি করতে পারেন না। অনেকে মনে করেন জমির অংশ চাইলে পিতা বা ভাইরা অসন্তুষ্ট হবেন, পরিবারে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে। এ কারণে অনেক নারী সংকোচে অধিকার আদায়ের উদ্যোগই নেন না।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলায় সাম্প্রতিক সময়ে এই সমস্যা আরও দৃশ্যমান হয়েছে। প্রাপ্ত অভিযোগে দেখা গেছে- অনেক নারীকে তাদের পৈত্রিক জমির ন্যায্য অংশ দেওয়া হয়নি, আবার কিছু ক্ষেত্রে ভাইরা গোপনে পুরো সম্পত্তি নিজেদের নামে রেকর্ড করে নিয়েছেন। বিয়ের পর মেয়েরা বাড়ির বাইরে থাকার সুযোগে রেকর্ড সংশোধনের মতো প্রতারণার ঘটনা ঘটছে।
এই বঞ্চনা রোধে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহবুব হাসান। নারীদের জমির অধিকার রক্ষা এবং অভিযোগ শোনার জন্য তিনি ‘অঙ্গনা সেবা’ নামে বিশেষ একটি সেল গঠন করেছেন। এখানে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, মহিলা সংস্থা ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো একসঙ্গে কাজ করছে।
উপজেলা প্রশাসন জানায়, এক খণ্ড জমি শুধু বসবাসের জায়গা নয়, এটি একজন নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সামাজিক মর্যাদার অন্যতম ভিত্তি। বিশেষ করে বিধবা, অসহায়, দুঃস্থ বা অসুস্থ নারীদের জন্য পৈত্রিক জমি জীবনযুদ্ধের বড় ভরসা। প্রয়োজনে জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া বা বিক্রি করে সংসারের প্রয়োজনে ব্যয় মেটানো সম্ভব। তাই জমির ন্যায্য অধিকার থেকে নারীদের বঞ্চিত করা আইনত অপরাধ এবং সামাজিক ব্যাধি।
এই বাস্তবতা বিবেচনায় ‘অঙ্গনা সেবা’ সেলে যেকোনো নারী সরাসরি এসে অভিযোগ জানাতে বা পরামর্শ নিতে পারবেন। জমি সংক্রান্ত অভিযোগ যাচাই-বাছাই, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই, রেফারেল, আইনি প্রক্রিয়া বোঝানোসহ সব ধরনের প্রশাসনিক সহায়তা দেওয়া হবে। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শুনানিও পরিচালনা করা হবে।
এছাড়া নারীরা চাইলে তাদের অন্যান্য অসুবিধার বিষয়ও শেয়ার করতে পারেন। যেমন বাল্যবিবাহ, নিপীড়ন, অত্যাচার বা অন্য যেকোনো পরিস্থিতি যা তারা এখানে শেয়ার করা প্রয়োজন মনে করেন। সেক্ষেত্রে তাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে রেফার বা প্রয়োজনীয় আইনানুগ পরামর্শ প্রদান করা হবে। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে অভিযোগ জানানো বা পরামর্শের জন্য নারী ভিকটিমদের জন্য তিনটি হটলাইনও সংযুক্ত করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহবুব হাসান সময়ের কণ্ঠস্বরকে জানান, বেশ কিছু নারী ইতোমধ্যে সম্পত্তি সংক্রান্ত অভিযোগ করেছেন। যেসব বিষয় স্থানীয় পর্যায়ে সমাধান করা সম্ভব, সেগুলোর শুনানি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তবে যেসব ক্ষেত্রে ভাইরা প্রতারণার মাধ্যমে বোনদের জমি নিজেদের নামে রেকর্ড করেছেন, সেগুলো সমাধান আদালতে যেতে হয়। এ ধরনের জটিল মামলার প্রক্রিয়া নারীদের বুঝিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতিতেও তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নারীদের জমি অধিকার নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নারী কর্মকর্তা ও শিক্ষিকাদের যুক্ত করা হচ্ছে, পাশাপাশি স্কুল-কলেজেও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ইউএনওর ভাষায়, 'উত্তরাধিকার আইন নারীদের বঞ্চিত করার সুযোগ দেয় না। এটি শুধু আইনি অপরাধ নয়, সামাজিক ব্যাধিও। পরিবারে কেউ যদি নারীর অধিকার হরণ করে, তা ভবিষ্যতে নিজেদের ওপরই ফিরে আসতে পারে।'
এদিকে ইউএনওর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ভূঞাপুরের সাধারণ মানুষ। তাদের মতে, ‘অঙ্গনা সেবা’ সেল এলাকার নারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। বহু নারী যেসব অভিযোগ এতদিন ভয়ে বা সংকোচে বলতে পারেননি, এখন তারা সেগুলো নির্ভয়ে তুলে ধরতে পারবেন।
এসকে/আরআই