আজ বিশ্ব এইডস দিবস। মানবসভ্যতায় মারণব্যধি রোগ ভয়াবহ হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান রোগ নিরাময়ে সক্ষম হলেও প্রাণঘাতী রোগ এইডস নিরাময়ে অক্ষম। ২০২৫ সালের মূল বার্তা ‘চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে, নতুনভাবে এইডস প্রতিরোধ গড়ে তোলা’।
এইডস রোগের ভাইরাস এইচআইভি শরীরে প্রবেশ করলে শরীরের রোগপ্রতিরোধক কোষ যেমন-হেলপারটি সেল, মনোসাইট, ম্যাক্রফেজ, ডেনড্রাইটিক সেল, চর্মের ল্যাঙ্গারহেন্স, মস্তিষ্ক ও গোয়াল সেল ইত্যাদিকে আক্রমণ করে এবং সেগুলোকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়। ফলে মানবদেহের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন যেকোনো সংক্রামক জীবাণু সহজেই এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে পারে। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু ঘটাতে পারে।
এইডস (অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিয়েন্সি সিনড্রোম) হলো এক প্রকার ভাইরাস দ্বারা গঠিত রোগ। যে রোগ এইচআইভি নামক ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। এইচআইভি একটি ভাইরাস যা মানুষের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। তাছাড়া এই ভাইরাসটি রক্তের সাদা কোষ নষ্ট করে দেয়, যার ফলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়া। তবে এইচআইভি এবং এইডস কিন্তু একই বিষয় নয়। এইচআইভি একটি ভাইরাস এবং এইডস একটি অসুস্থতা, যা এইচআইভির কারণে হয়।
প্রতি বছর সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ মারা যায় মারণব্যধি এইডসের কারণে। বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি (এইডসের ভাইরাস) পজিটিভ ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এর মধ্যে এবার এইডসে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ।
এইডস বা এসটিডি কন্ট্রোলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২৪ সালে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪৩৮ জন, মারা গেছেন ১৯৫ জন। ২০২৩ সালে আক্রান্ত হন ১ হাজার ২৭৬ জন এবং মৃত্যু হয় ২৬৬ জনের। আর চলতি বছর আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়াতে পারে দেড় হাজার। একদিকে যখন সীমা ছাড়িয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা অন্যদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে এইডস নিমূলের পরিকল্পনা করছে সরকার।
এইচআইভি নামক ভাইরাস সর্বপ্রথম আমেরিকায় বিজ্ঞানীদের মাঝে ধরা পড়লেও রোগটি আফ্রিকা থেকেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হয়। এইডসের বিস্তার ইতোমধ্যে মহামারি রূপ নিয়েছে বলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন দেশ ভারত, মিয়ানমার ও নেপালে ইতোমধ্যে এইডস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশ এখনো মৃদু আক্রান্তের দেশ হিসেবে বিবেচিত, তথাপি প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং মিয়ানমারে এ রোগের দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশও ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রতিনিয়তই ঊর্ধ্বমুখী এইচআইভি বা এইডস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা।
গবেষণা বলছে, আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ শতাংশই সমকামী। এইডস প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে ১ ডিসেম্বর পালিত হয় বিশ্ব এইডস দিবস। আর ২০৩০ সাল নাগাদ দেশ থেকে এইচআইভি বা এইডস নির্মূলের পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকারের।
রাজধানীতে এলার্জি পরীক্ষা করতে গিয়ে এইডস শনাক্ত হয় এক যুবকের। তিনি জানান, সমকামিতায় জড়িয়ে যাওয়ায় এমন পরিণতি তার।
ওই যুবক বলেন, এই ভুল পথে না যেতে সবাইকে অনুরোধ করবো। একটা ভুলের জন্য সারাজীবন পস্তাতে হয়। আমি চাই না, আমার মতো কেউ এভাবে পস্তাক।
চিকিৎসকরাও বলছেন একই কথা। চিকিৎসক ড. এ আর এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বর্তমানে দেশে এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই সমকামী। এ ছাড়া ৪০ শতাংশের মতো বিদেশ থেকে এ রোগ বহন করে নিয়ে আসে। আর ব্ল্যাড বা এ জাতীয় বিভিন্নভাবে কিছু লোক আক্রান্ত হন।
ঢাকার সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল দেশের একমাত্র বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র। চলতি বছর এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৩০০ এইচআইভি রোগী। বর্তমানে ভর্তি আছেন ১২ জন। কিট সংকটের পাশাপাশি জনবলের অভাবে বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও তা পাচ্ছেন না রোগীরা।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাসার বলেন, আমাদের এখানে যারা আসেন, তারা খুব খারাপ পর্যায়ে এসে ভর্তি হন। এখানে আসা রোগীদের এইচআইভি ছাড়াও অন্যান্য রোগ থাকে। এগুলোর জন্য যে ধরনের ল্যাবের সাপোর্ট দরকার, সেটা আমরা তাদেরকে দিতে পারি না।
দেশব্যাপী এইডস শনাক্তকরণ কেন্দ্রগুলোতেও আছে কিট সংকট। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে চলতি সপ্তাহেই কেটে যাবে তা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় এইডস বা এসটিডি কন্ট্রোলের পরিচালক ডা. মো. খায়রুজ্জামান বলেন, ‘কিটের কিছুটা স্বল্পটা ছিল। বিমানবন্দরে যখন কিট আসে, এর এক বা দুইদিন আগে আগুন লাগে। তাই ওই কিট আমরা এখনও পাইনি। তবে কয়েক দিনের মধ্যে কিট পেয়ে যাব।’
একই বেডে ঘুমালে কিংবা একই প্লেটে খেলে এইডস ছড়ায় না। চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন এইচআইভি রোগীরা।
এইচআইভি সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই সর্বদা এইডস হয় না। শুরুতে ক্ষেত্র বিশেষ ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এরপর বহুদিন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। এইচআইভি ভাইরাসের আক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র দুর্বল হতে থাকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণ সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এমনকি সংক্রামক ব্যাধি বা টিউমারের শিকারও হতে পারেন, যেগুলো কেবলমাত্র সে সব লোকেরই হয় যাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজ করে না। এইচআইভি সংক্রমণের এই পর্যায়টিকে এইডস বলা হয়।
এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীই কোনো লক্ষণ ছাড়া এই রোগ বহন করে। তবে কখনো কখনো এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ পরে কিছু কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন- জ্বর, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা, মুখের অভ্যন্তরে ঘা, দীর্ঘমেয়াদি কাশি, স্বাস্থ্যের অবনতি, লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠা ইত্যাদি। এই সব লক্ষণ কোনো চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যায়, যার কারণে রোগী এই ভাইরাস সম্পর্কে বুঝতে পারেন না। এইচআইভি ভাইরাস কোনো রকম লক্ষণ ছাড়াই সর্বোচ্চ ১০ বছর মানুষের শরীরে বাস করতে পারে। বর্তমানে এইডস একটি ভয়াবহ রোগ হিসেবে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সর্বপ্রথম ১৯৮১ সালে আমেরিকায় এই রোগ আবিষ্কৃত হয়। ১৯৮৫ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে রক্তে এইচআইভি ভাইরাস জীবাণুমুক্ত কি না স্ক্রিনিং করে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল রক্ত সরবরাহ করার পরামর্শ দেন। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য ছিল একসময়, তখন এই রোগকে ঘাতক রোগ বলা হতো।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, মানবদেহে বিভিন্নভাবে এইডস রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা বীর্য বা জরায়ু রসের সঙ্গে যদি সুস্থ কোনো ব্যক্তির রক্ত, শরীর রস বা মিউকাশ আবরণের সংস্পর্শ ঘটে, তবে এইচআইভি তথা এইডস রোগের বিস্তার ঘটে। এসব সংস্পর্শ নানাভাবে ঘটতে পারে। যেমন- কনডম ব্যবহার না করে অবাধ যৌন সহবাস, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত শরীরে ধারণ বা গ্রহণ, অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা দাঁতের চিকিৎসা বা অপারেশনসহ আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ব্যবহার। এমনকি সংক্রমিত গর্ভবতী নারী থেকে শিশুর দেহে পর্যন্ত এ রোগ ছড়াতে পারে।
এইডস রোধকল্পে উন্নত দেশসহ তৃতীয় বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত প্রতিকারের বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিলে এইডসের ছোবল থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারবে নিশ্চিত। যেমন- অবাধ যৌনাচার বন্ধ করে নিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, যৌন মিলনের ক্ষেত্রে কনডম ব্যবহার নিশ্চিত করা, রক্ত সংগ্রহের পূর্বে রক্তদাতার রক্ত পরীক্ষা করা, গর্ভাবস্থায় মায়ের এইডস ছিল কি না তা পরীক্ষা করা, সুচ-সিরিঞ্জ জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা, মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা, প্রচার মাধ্যমগুলোকে এ ব্যাপারে সক্রিয় করা।
এইচআইভি একবার কোনোভাবে শরীরে ঢুকে গেলে তখন তাকে পুরোপুরি দূর করাও যায় না। চিকিত্সার দ্বারা এর লক্ষণ বা জটিলতাগুলো আরও কিছু বছর পিছিয়ে রাখা যায় মাত্র। এইচআইভির বিরুদ্ধে আজও কার্যকরি প্রতিষেধক টিকা এবং কোনো ওষুধও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই প্রতিরোধ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এইডস প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে হবে। বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে হবে। গণমাধ্যমে এইডস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে।
এইচএ