বাংলাদেশের বৃহৎ শুঁটকি উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার চলনবিল এলাকায় এ বছর শুঁটকি উৎপাদনে বড় ধরনের ধস নেমেছে। প্রাকৃতিক মাছের স্বল্পতা, নির্বিচারে দেশীয় মাছ শিকার এবং অপরিকল্পিতভাবে চায়না দোয়ারি জাল ব্যবহারের কারণে শুঁটকি মাছ ব্যবসা ও শ্রমবাজারে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
উপজেলার লাহিড়ী মোহনপুর, উধুনিয়া ও বড়পাঙ্গাসী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ চলনবিল এলাকাজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে কমপক্ষে ১০টি শুঁটকি পল্লী গড়ে উঠেছিল। ভরা মৌসুমে এখান থেকে প্রায় ৬শ টনের মতো শুঁটকি উৎপাদন হয়ে দেশের বড় পাইকারি বাজার ঢাকা, সৈয়দপুর, নীলফামারী, জামালপুর, তিস্তা অঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হতো।
কিন্তু চলতি বছরে সেই উৎপাদন অর্ধেকের অনেক নিচে নেমে এসেছে। শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ষা মৌসুমে বিল-জলাশয়ে প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছ থাকলেও মা মাছ ও রেনুপোনা নির্বিচারে শিকার করায় মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে চায়না দোয়ারি জাল দিয়ে বর্ষার শুরু থেকেই এসব ছোট-বড় সব ধরনের মাছ মারার ফলে মাছের সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমে গেছে। দেশে প্রাকৃতিক মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব পড়ছে শুঁটকি উৎপাদনে।
উল্লাপাড়া উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী গতবছর উল্লাপাড়ায় শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৮৫ মেট্রিকটন কিন্তু চলতি বছরে যা নেমে এসেছে ৮০ মেট্রিকটন। এই এলাকার অন্তত ৩০ জন শুঁটকি ব্যবসায়ী রয়েছে। মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এই ব্যবসা থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, চলনবিলে যেসব মাছ দিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করা হয় তার মধ্যে রয়েছে পুঁটি, ট্যাংরা, দারকানী, গজই, বাইম, দোতরা, মৌকা ও খলিসা। তবে এসব দেশীয় প্রজাতির মাছ এখন বিল-জলাশয়ে আগের মতো আর পাওয়া যায় না। মাছের সংকট বাড়ায় শুঁটকি উৎপাদনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছে না। তিনি আরো জানান প্রতিবছর তিনি অন্তত দেড়শো টন শুটকি উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করতেন । এবছর লক্ষ্যমাত্রা নেমে এসেছে মাত্র ৫০ টন। চলনবিলের শুঁটকির বেশ চাহিদা রয়েছে, কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে তারা পাশাপাশি বাজার হারাচ্ছে।
শুধু ব্যবসায়ীরাই নয় শুঁটকি উৎপাদনশীল প্রতিটি পল্লীতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন শতাধিক নারী-পুরুষ। উৎপাদন কমে যাওয়ায় এখন তারা কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শুঁটকি পল্লীর শ্রমিক নুর মোহাম্মদ বলেন দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাওয়ায় চাতাল গুলোতে শুঁটকি উৎপাদন কমে গেছে, এতে তারা কর্মহীন হয়ে পড়ছে।
বড়পাঙ্গাসী গ্রামের আমিনা খাতুন বলেন তিনি এখানে ৩০ বছর হলো কাজ করেন। দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাওয়ায় তারা নিয়মিত কাজ পাচ্ছে না। তার অভিযোগ বছরের পর বছর ধরে চলনবিলে চায়না দোয়ারি জালের ব্যবহার বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না উপজেলা মৎস্য অফিস। এর ফলে দেশীয় মাছের বিলুপ্তি যেমন বাড়ছে, তেমনি শুঁটকি উৎপাদনও মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয়রা দ্রুত অবৈধ জাল অভিযান জোরদার, চলনবিলের জলাশয় রক্ষা এবং দেশীয় মাছ প্রজননে অনুকূল পরিবেশ তৈরির দাবি জানিয়েছেন।
উল্লাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আতাউর রহমান জানান চলতি বছরে বন্যার পানি কম থাকায় মাছের প্রজনন কমে গেছে। এছাড়াও বন্যার শুরুতে চায়না দোয়ারি জালের দৌরাত্ম থাকায় দেশীয় প্রজাতির মাছ ফাঁদে পড়ছে। তিনি আরো জানান উল্লাপাড়ায় চলতি বছরে শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮০ মেট্রিকটন নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইখা