চট্টগ্রাম নগর জুড়ে আবারও তীব্রভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ভূমিকম্প–আতঙ্ক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমাগত ভূকম্পন অনুভূত হওয়া মাত্রই চসিক ও সিডিএর নীরব প্রশাসনিক চাকা হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে অচল অবস্থায় পড়ে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্তের কাজ নতুন করে শুরু হয়। আর এই হালনাগাদ তালিকাই নগরবাসীর সামনে তুলে ধরে উদ্বেগ–উদ্দীপক এক বাস্তবতা, চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণে পৌঁছে গেছে।
২০০৭ সালে সিডিএ নগরের ৫৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে ভেঙে ফেলার সুপারিশ করে। ভূমিকম্পের ঝুঁকির কথা ভেবে চসিক কিছুদিন সেই কাজে নেমেও ছিল, তবে রাজধানীর রানা প্লাজা ধসের পর ২০১৩ সালে শুরু হওয়া অভিযানের লাগাম বেশিদূর টিকেনি। কিছুদিনের মধ্যেই অভিযান স্থবির হয়ে যায়, আর সিডিএ–চসিকের দুই সংস্থা ফিরে যায় আগের অচেতনতায়, একদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা হালনাগাদের উদ্যোগ নেই, অন্যদিকে ভবন অপসারণেও নেই কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম।
এরপর অবশেষে এসে সবকিছু নতুনভাবে আলোচনায় আসে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোর ধাক্কায়। এক দশকেরও বেশি সময়ের নীরবতার পর সিডিএ নতুন করে চিহ্নিত করে ১০২টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে। তালিকা হস্তান্তর করা হয় চসিককে। এই সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আগের তালিকায় থাকা মোট ৫৭টি ভবনের মধ্যে মাত্র ৬টি ভেঙে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ ৫১টি ভবন আগের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়ে গেছে, আর অতিরিক্ত নতুনভাবে চিহ্নিত হয়েছে আরও বহু ভবন। দেড় যুগের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বেড়ে হয়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ, যা নগরের ভবন নিরাপত্তা ও নগর পরিকল্পনার ওপর গভীর প্রশ্ন তোলে।
নতুন তালিকার ভবনগুলো বিশ্লেষণ করলে নগরের ভয়াবহ দুরবস্থা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ ভবনই আবাসিক, যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের বসবাস। আবার রয়েছে বহু বাণিজ্যিক স্থাপনা, দোকানপাট, অফিস, স্কুল, কলেজ ও প্রশাসনিক স্থাপনা, যা ধসের মুখে পড়লে অনিবার্য মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। নগরের প্রধান প্রধান এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এসব ভবন বয়সে কারো ৫০ বছরের ওপরে, কারো আবার ১০০ বছরেরও বেশি। বহু ভবনে ইতোমধ্যেই বীম–কলাম দুর্বল হয়ে পড়েছে, দেয়ালে দেখা দিয়েছে বড় ফাটল। কাঠামো এতটাই নষ্ট হয়ে গেছে যে সামান্য ঝাঁকুনিতেই ভবনগুলো ধসে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
কিছু ভবনের পরিণতি আরও ভয়াবহ। আগ্রাবাদ মৌলভীপাড়ার ছোবহান ভবন ১৭ বছর ধরে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র বারিক বিল্ডিং এলাকায় রফিকের মালিকানাধীন একটি ভবনের দেয়ালে প্রকট ফাটল দেখা দিয়েছে, ভিতরে কাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে। রহমতগঞ্জের নূর নাহার বেগমের ভবনও একপাশে হেলে পড়েছে, যা যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। একইভাবে নাসিরাবাদের পুরোনো টিটিসি বিল্ডিং দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে, এখনো সেটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় স্থান দখল করে আছে। স্কুল–কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তালিকায়, যা শত শত শিক্ষার্থীর জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করেছে। রেয়াজুদ্দিন বাজারের দারুল ফজল মার্কেটও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত, যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ যাতায়াত করেন, ব্যবসা–বাণিজ্য চালান।
এই ভয়াবহ তালিকা হাতে পাওয়ার পর চসিক অবশেষে জেগে ওঠে। গতকাল সোমবার চসিকের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন চসিকের আইন কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মুরাদ। আগামীকাল থেকেই ভবন মালিকদের নোটিশ দেওয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন চসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আমিন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ভবন মালিকদের সময় দেওয়া হবে, তারা নিজেরা স্বেচ্ছায় ভবন ভেঙে ফেলতে চাইলে তা করতে পারবেন। না চাইলে চসিক আইনগত ব্যবস্থা নেবে। পাশাপাশি সিডিএকে চিঠি দিয়ে প্রতিটি ভবন কোন ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে তার বিস্তারিত চাওয়া হবে, যাতে ভবন মালিকরা যেন কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হন।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান জানায়, বর্তমানে নগরে মোট ভবনের সংখ্যা ৩ লাখ ৮২ হাজারের বেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই একতলা, বাকি অংশ ২ থেকে ২০ তলা পর্যন্ত বিস্তৃত। উচ্চ ভবনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়, তবে ভবন নির্মাণের মান এবং নকশা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বহু বছর ধরে উদাসীনতা দেখা গেছে। ২০০৯–২০১১ সালের ভূমিকম্প ঝুঁকি মূল্যায়নে দেখা যায়, চট্টগ্রামের ভবনগুলোর ৯২ শতাংশই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সেই পুরোনো পরিসংখ্যান এখন আরও গুরুতর ও বাস্তবসম্মত হয়ে উঠেছে নতুন তালিকার বিস্ফোরক তথ্যের কারণে।
নগরের এমন বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চট্টগ্রাম এখনো একটি বড় মাপের ভূমিকম্প বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। বহুতল ভবন, পাহাড় ধস, ভিটেমাটি দুর্বলতা, সবকিছু মিলিয়ে নগরের সামগ্রিক অবকাঠামো জোড়াতালি দিয়ে টিকে আছে। যেকোনো বড় কম্পনেই হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের উদ্যোগ যদি আবারও কাগজে–কলমে বন্দি হয়ে পড়ে, তবে যে বিপর্যয় সামনে এসে দাঁড়াবে, তা সামলানো চসিক বা সিডিএর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
এসআর