নসিহত মানে শুধু উপদেশ নয়, এটা হলো এমন এক আমল, যেখানে থাকে দয়া, ভালোবাসা, সতর্কতা, আন্তরিকতা ও কল্যাণের পূর্ণ প্রকাশ। কারণ যে সমাজে নসিহত বা উপদেশ বন্ধ হয়ে যায় সেখানে পাপ, অন্যায়, বিভেদ ও শয়তানের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। সেখানে আমাদের করণীয়—
> সবাইকে সুন্দরভাবে উপদেশ দেওয়া;
> কঠোর ভাষা নয়, মমতার ভাষা ব্যবহার করা;
> অন্যের ত্রুটি ঢেকে দিয়ে নরমভাবে সংশোধনের চেষ্টা করা
> নিজের আমল আগে ঠিক করা
> সমাজে নসিহত বা উপদেশের পরিবেশ তৈরি করা। যেভাবে নবিজী (সা.) তার প্রিয় সাহাবি হজরত মুয়াজকে (রা.) উম্মতের শিক্ষার জন্য ১০টি জীবনঘনিষ্ঠ উপদেশ দিয়েছিলেন। যা তুলে ধরা হলো—
হজরত মুয়াজ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে দশটি বিষয়ে অসিয়ত বা উপদেশ দিয়েছেন। তিনি (সা.) বলেছেন—
لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ شَيْئًا وَإِنْ قُتِلْتَ وَحُرِّقْتُ وَلَا تَعُقَّنَّ وَالِدَيْكَ وَإِنْ أَمَرَاكَ أَنْ تَخْرُجَ مِنْ أَهْلِكَ وَمَالِكَ وَلَا تَتْرُكَنَّ صَلَاةً مَكْتُوبَةً مُتَعَمِّدًا فَإِنَّ مَنْ تَرَكَ صَلَاةً مَكْتُوبَةً مُتَعَمِّدًا فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ ذِمَّةُ اللَّهِ وَلَا تَشْرَبَنَّ خَمْرًا فَإِنَّهُ رَأَسَ كُلِّ فَاحِشَةٍ وَإِيَّاكَ وَالْمَعْصِيَةَ فَإِنَّ بالمعصية حل سخط الله عز وَجل وَإِيَّاكَ وَالْفِرَارَ مِنَ الزَّحْفِ وَإِنْ هَلَكَ النَّاسُ وَإِذا أصَاب النَّاس موتان وَأَنت فيهم فَاثْبتْ وَأنْفق عَلَى عِيَالِكَ مِنْ طَوْلِكَ وَلَا تَرْفَعْ عَنْهُمْ عَصَاكَ أَدَبًا وَأَخِفْهُمْ فِي اللَّهِ
১. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় অথবা আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
২. মা-বাবার অবাধ্য হবে না, যদি বাবা-মা তোমাকে তোমার পরিবার-পরিজন বা ধন সম্পদ ছেড়ে দেওয়ার হুকুমও দেয়।
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো কোনো ফরজ নামাজ ছেড়ে দিও না। কারণ, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ফরজ নামাজ ছেড়ে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার থেকে দায়িত্ব উঠিয়ে নেন।
৪. মদপান থেকে বিরত থাকবে। কেননা তা সব অশ্লীলতার মূল।
৫. সাবধান! আল্লাহর নাফরমানি ও গুনাহ থেকে বেঁচে থাক, কেননা নাফরমানি দ্বারা আল্লাহর ক্রোধ অবধারিত হয়ে যায়।
৬. জিহাদ থেকে কখনো পালিয়ে যাবে না, যদিও সব লোক মারা যায়।
৭. যখন মানুষের মধ্যে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে আর তুমি সেখানেই রয়েছ, তখন সেখানে তুমি অবস্থান করবে (পলায়নপর হবে না)।
৮. শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করবে (কার্পণ্য করে তাদের কষ্ট দেবে না)।
৯. পরিবারের লোকদেরকে আদব-কায়দা শিক্ষার জন্য কখনো শাসন থেকে বিরত থাকবে না।
১০. আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করতে থাকবে। (মুসনাদে আহমাদ ২১৫৭০, তারগীব ২৩৯৪, মিশকাত ৬১)
এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার প্রিয় সাহাবি হজরত মুয়াজ ইবনে জাবালকে (রা.) যে ১০টি নসিহত বা উপদেশ শিক্ষা দিয়েছেন, তাতে একজন মুমিনের পুরো জীবনের মানচিত্র অঙ্কিত রয়েছে। তাওহিদ রক্ষা, পিতা-মাতার আনুগত্য, নামাজে স্থিরতা ও পাপ থেকে দূরে থাকা— এগুলো মানুষের ইমানকে দৃঢ় করে। এসব অসিয়তের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা অর্জনের মূল পথগুলো। একজন মুসলিমের চরিত্র, আচরণ ও পারিবারিক দায়িত্ব কীভাবে হওয়া উচিত— তার বাস্তব রূপরেখা ফুটে ওঠেছে এই হাদিসের নসিহতগুলোতে।
মনে রাখতে হবে
> তাওহিদ রক্ষা— জীবন ও ইমানের ভিত্তি;
> পিতা-মাতার সন্তুষ্টি— জান্নাতের পথ;
> নামাজ ত্যাগ— ইমানকে দুর্বল করে;
> পাপ থেকে দূরে থাকা— আল্লাহর রহমত আনে;
> পরিবারকে আল্লাহর পথে গড়াই প্রকৃত সফলতা।
হে প্রিয় মুসলিম উম্মাহ!
আজ আমাদের সমাজে যুবকদের মধ্যে তাওহিদের জ্ঞান কমে যাচ্ছে, নামাজকে হালকা ভাবে নেওয়া স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পিতামাতার সামনে উচ্চস্বরে কথা বলা এখন আর অপরাধ মনে হয় না। মোবাইল, ইন্টারনেট ও অবাধ ফিতনা মানুষকে পাপের দিকে টেনে নিচ্ছে। ঘরগুলোয় ইলম নেই, আল্লাহভীতি নেই, ফলে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি, সন্তানদের চরিত্রে দুর্বলতা, সমাজে অস্থিরতা নেমে আসছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অসিয়তগুলো ভুলে যাওয়ার ফলেই দয়া, নৈতিকতা, শান্তি-সবকিছুই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। উম্মাহ যদি আবার নববি নসিহতে ফিরে আসে, তবে ঘর, সমাজ, দেশ-সবকিছুতে ফিরবে রহমতের আলো।
সুতরাংউম্মতের প্রতি নসিহা হলো—
> আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না, যে পরিস্থিতিই আসুক।
> পিতা-মাতার খেদমতকে নিজের ইবাদত বানিয়ে নাও।
> নামাজ কখনো ইচ্ছা করে বাদ দিও না, এটাই ইমানের চাবি।
> পাপের দরজা থেকে দূরে থাকো, পাপ আল্লাহর গজবকে ডেকে আনে।
> পরিবারকে দ্বীনের পথে শিক্ষিত কর, এটাই সর্বোচ্চ দায়িত্ব।
> বিপদ ও মহামারিতে ধৈর্য ধর, এতে আল্লাহর হেফাজত আছে।
> সমাজে কল্যাণ ছড়াও ‘দ্বীন হলো নসিহা’- এই সত্যকে ধারণ কর।
যারা এই অসিয়তগুলো আঁকড়ে ধরবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য বারাকাহ ও নিরাপত্তার দরজা খুলে দেবেন।
এবি