আজ ১০ ডিসেম্বর। দক্ষিণের দ্বীপজেলা ভোলা ও নড়াইল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকহানাদার বাহিনীকে হটিয়ে বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠেন এই দুই জনপদের মানুষ।
জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বর দক্ষিণের দ্বীপজেলা ভোলার জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয় ভোলা। ১৬ ডিসেম্বরের ছয় দিন আগেই ভোলায় উড়েছিল লাল-সবুজ পতাকা। আর সেই বিজয়ের স্মৃতিতে প্রতিবছরই এই দিনে ভোলাবাসী নতুনভাবে ফিরে দেখে তাদের সংগ্রাম আর মুক্তির ইতিহাসকে।
তথ্যানুসারে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে পাকবাহিনী চরমভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। জীবন বাঁচাতে ১০ ডিসেম্বর ভোরে তারা কার্গো লঞ্চে ভোলা ছাড়তে বাধ্য হয়। তাদের সরে যাওয়া মাত্রই মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করে নিয়ন্ত্রণ নেন সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সকালে বর্তমান জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের ছাদে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ভোলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভোলার সরকারি স্কুল মাঠ, বাংলা স্কুল, টাউন স্কুল মাঠ ও ভোলা কলেজ এলাকায় তৈরি হয়েছিল প্রশিক্ষণ শিবির। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর তুমুল সম্মুখযুদ্ধ হয় ঘুইংঘারহাট, দৌলতখান, বাংলাবাজার, বোরহানউদ্দিনের দেউলা এবং চরফ্যাশন বাজারে। যুদ্ধে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেন। পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে খেয়াঘাটে হত্যা করে মরদেহ তেঁতুলিয়া নদীতে ফেলে দিতো।
এ ছাড়াও নারীসহ অসংখ্য নিরীহ মানুষকে ধরে ওয়াপদা কলোনীসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করত। তাদের মরদেহ গণকবরে রাখা হতো। পাকবাহিনীর পলায়নের পর ওয়াপদা এলাকা থেকে ৩০ জন বীরাঙ্গনাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
ভোলার পাউবো অফিস, ওয়াপদা কলোনী ও বাংলা বাজার ছিল নৃশংসতার প্রধান কেন্দ্র। এর মধ্যে পাউবো ও বাংলাবাজারের যুদ্ধক্ষেত্র বর্তমানে সংরক্ষিত হলেও অন্য বধ্যভূমি এখনও অবহেলিত। মুক্তিযোদ্ধারা এসব স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আলম নিরব জানান, ৬ মে বরিশাল থেকে লঞ্চযোগে পাক সেনারা ভোলায় আসে। স্থানীয় একাংশ রাজাকারদের সহযোগিতায় তারা ওয়াপদা কলোনীতে অবস্থান নেয়। এরপর পুরো শহর ফাঁকা হয়ে যায় মানুষের ভয়ে। প্রতিরাতে রাজাকারদের সহায়তায় বাড়ি বাড়ি তল্লাশি ও নির্যাতন চালাত হানাদাররা।
১০ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা ভোলার অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিলেও হানাদাররা গুলি ছুড়ে পালানোর চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধা কাজী জয়নাল ও ফিরোজের নেতৃত্বে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধার দল পেছন থেকে থেকে ধাওয়া করলে পাকবাহিনী শেষ পর্যন্ত পুরান লাশকাটা ঘাটে থাকা কার্গো লঞ্চে উঠে ভোলা থেকে পালিয়ে যায়। পরে জানা যায়, ওই লঞ্চটি চাঁদপুরের মেঘনায় মিত্রবাহিনী বোমা মেরে ডুবিয়ে দেয়।
ভোলামুক্তির খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজারও মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন বিজয়ের উল্লাসে। সকাল ১০টার দিকে জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের ছাদে লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোলাকে মুক্ত ঘোষণা করা হয়।
এদিকে, আজ বুধবার হানাদারমুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে র্যালি, আলোচনা সভা ও বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছেন সেই রক্তঝরা দিনগুলোকে।
অপরদিকে, আজ ১০ ডিসেম্বর নড়াইল মুক্ত দিবস। নড়াইলের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালের এই দিন নড়াইলকে সম্পূর্ণভাবে শত্রু মুক্ত করতে সক্ষম হন। এর আগে কালিয়া এবং ৮ ডিসেম্বর লোহাগড়া মুক্ত হয়।
জানা যায়, শহীদ মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণার ডাক দেওয়ার পর অন্যান্য স্থানের মত নড়াইলবাসী পুরোপুরি যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে উদ্ধুদ্ধ হয়। স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতা যেকোন কিছুর বিনিময়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলা করার শপথ গ্রহণ করে। ওই সময় নড়াইলের এসডিও’র বাসভবনকে মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় সদর দপ্তর করা হয়েছিল।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী লোহাগড়া হাইস্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও নড়াইলের সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিশাল বাহিনী গঠন করে যশোর অভিমুখে পাঠিয়ে দেন। ৬ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দুটি জেট বিমান হতে নড়াইল শহরের ওপর ব্যাপক মেশিনগানের গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে প্রচুর ক্ষতি সাধন করলে নড়াইল শহর জনমানব শুন্য হয়ে পড়ে।
১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে আহত করে। এদিকে লোহাগড়ার ইতনা ও আড়িয়ারায় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবির খোলার কারনে মধুমতি-নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভাটিয়াপাড়াস্থ ক্যাম্প হতে পাক হানাদার বাহিনী ২৩ মে গানবোট যোগে ইতনা গ্রামে ঢুকে নৃশংস অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের ৫৮ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুক্তিকামী হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে নড়াইলে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন অঞ্চলে পাকহানাদারবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের চলে তুমুল যুদ্ধ। শুধুমাত্র নড়াইল চিত্রা নদীর পাড়ে (প্রধান ডাকঘরের পার্শে) প্রায় ৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। এছাড়া নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর গ্রামের তরফদার পরিবারের স্কুল শিক্ষক আতিয়ার রহমান তরফদার, আব্দুস সালাম তরফদার, রফিউদ্দিন তরফদার, মাহতাব তরফদার ও আলতাব তরফদার এবং মোকাম মোল্যা, কাইজার মোল্যা ও মকবুল হোসেন শিকদারকে ধরে এনে নড়াইল শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভেতরে গণ-কবর দেয় পাকহানাদার বাহিনী।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশ হানাদার মুক্ত করার আকাংখা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে প্রবেশ করেন। অক্টোবর মাস হতে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিপাগল মানুষের মনে এক বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে হানাদার বাহিনী আর বেশীদিন টিকতে পারবে না। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বাঞ্চাল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। মুক্তি বাহিনীর কমান্ডাররা লোহাগড়া থানার পাক হানাদার বাহিনীরকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিলে তারা আত্নসমর্পন করেনি। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি গ্রুপ একত্রিত হয়ে সম্মিলিত ভাবে লোহাগড়া থানা আক্রমণ করলে প্রচন্ড যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পন করে।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ৯ ডিসেম্বর বিজয়ের তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইল সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালানোর পর হানাদারবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে বাগডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহীদ হন। ওই দিনই শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত ৪০ জন পাক মিলিটারিকে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিলে তারা আত্মসমর্পনে অস্বীকৃতি জানান।
এসময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চর্তুদিক থেকে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুরু করলে পাক মিলিটারিরা আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এখানে একজন পাক মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের জেল হাজতে পাঠানো হয়। শীতের রাতে প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সারা রাত শহরে বিজয় উল্লাস করতে থাকেন স্লোগানে স্লোগানে শহর প্রকম্পিত করে তোলেন এবং ১০ ডিসেম্বর দুপুর একটা ১৫ মিনিটে নড়াইলকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়। পরে ডাকবাংলো প্রঙ্গনে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে নড়াইলে ৫ জন খেতাব প্রাপ্ত হন তারা হলেন- বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, বীর উত্তম মুজিবুর রহমান, বীর বিক্রম আফজাল হোসেন, বীর প্রতীক খোরশেদ আলম ও বীর প্রতীক মতিয়ার রহমান।
এদিকে নড়াইল মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসন আয়োজিত সকালে শহরের জজ কোর্ট সংলগ্ন বধ্যভূমিতে পুম্পস্তবক অর্পণ, পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস চত্বরে গণকবরে পুম্পস্তবক অর্পণ, জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির রয়েছে।
ইখা